Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার

থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি সংস্কারের নামে হরিলুট

ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ৫ বছরে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা

Icon

মতিউর রহমান ভান্ডারী, সাভার

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি সংস্কারের নামে হরিলুট

মো. রশিদ মোল্লা এবং মো. রশিদ মোল্লা ‘রনি’ একই ব্যক্তি। টেন্ডার জালিয়াতি করার জন্যই মূলত রশিদ মোল্লা তার নামের শেষে ‘রনি’ যুক্ত করেছেন। মো. রশিদ মোল্লা ‘রনি’ পরিচয়ে ‘মেসার্স সিলভা এন্টারপ্রাইজ’ ও মো. রশিদ মোল্লা পরিচয়ে ‘মেসার্স অনামিকা এন্টারপ্রাইজ’ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আর এই দুই প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রতিযোগী দেখিয়ে টানা পাঁচ বছর নির্মাণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন রশিদ মোল্লা। গাজীপুর অঞ্চলের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ির সংস্কার কাজের জন্য যতগুলো টেন্ডার কল করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগেরই কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। রশিদ মোল্লার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার থানা সংস্কার ও নির্মাণ কাজের ভুয়া বহু প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মো. আব্দুর রশিদ মোল্লা (৪৫) গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানার ইসলামপুর দত্তপাড়া মহল্লার মো. ছামাদ মোল্লার ছেলে। 

দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানে সাভার হাইওয়ে থানা সংস্কারসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে একটি আবেদন করে এ প্রতিবেদক। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে পাঁচ বছরের টেন্ডার ডকুমেন্টের ৩ শতাধিক পৃষ্ঠা সরবরাহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে রশিদ মোল্লার এ জালিয়াতি ধরা পরে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি সংস্কারের জন্য আলাদা আলাদা পাঁচটি লটে একটি দরপত্র আহ্বান করেন গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার। ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ২৬ হাজার ৯৬৫ টাকা। এ সংক্রান্ত টেন্ডারে অংশ নিয়েছে রশিদ মোল্লার এই দুই প্রতিষ্ঠান। অভিজ্ঞতার সনদ হিসাবে যুক্ত করেছে এই পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন কাজের হিসাব নিকাশ। 

এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবছরের টেন্ডারের অভিজ্ঞতা সনদেও তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কাজের তথ্য যুক্ত করেছেন। এভাবে তিনি পাঁচ বছর পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে কৌশলে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। পাঁচ বছরে নির্মাণ ও সংস্কারসহ অন্যান্য কাজের নামে তিনি কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘মেসার্স সিলভা এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘মেসার্স অনামিকা এন্টারপ্রাইজের প্রধান কার্যালয় গাজীপুরের দত্তপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, রশিদ মোল্লার টেবিলে পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সিল স্বাক্ষরিত ‘মেসার্স অনামিকা এন্টারপ্রাইজ’-এর চারটি ব্ল্যাংক প্যাড। ওই প্যাডে তিনি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৬নং লটের কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দর উল্লেখ করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রশিদ মোল্লা তড়িঘড়ি করে প্যাডগুলো তার ড্রয়ারে রেখে দেন। নামের শেষে ‘রনি’ যুক্ত করে জালিয়াতির বিষয়ে রশিদ মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, কম্পোজ মিস্টেকের কারণে নামের সঙ্গে রনি যুক্ত হয়েছে। টানা পাঁচ বছর টাইপিং মিস্টেকের কারণ জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নেয়। তবে, একই ব্যক্তির দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিনা তা যাচাই করে দেখা হয়নি। 

পরিকল্পিত দুর্নীতি : সাভার হাইওয়ে থানার পূর্বদিকের ১৫০ ফুট ভাঙা সীমানাপ্রাচীর পুনঃনির্মাণ, পূর্বদিকের অবশিষ্ট ওয়ালের উচ্চতা ১.৫ ফুট বৃদ্ধিকরণ, কাঁটাতার স্থাপন ও রঙকরণসহ উত্তর দিকের অবশিষ্ট অংশ রঙকরণ ও কাঁটাতার স্থাপন, দক্ষিণ দিকের সম্পূর্ণ রঙকরণ কাজ, সেন্ট্রি পোস্ট পুনঃনির্মাণ, গেট মেরামত সংস্কার এবং ব্যারাক ভবন মেরামত সংস্কার এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সম্পূর্ণ সীমানা ১.৫ ফুট উচ্চতাকরণ, প্লাস্টার, সীমানার উপরে কাঁটাতার স্থাপন, ফাঁড়ির চার পাশের পুরো সীমানা রঙকরণ ও পুরাতন ব্যারাক ভবন মেরামত সংস্কারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পৃথক পাঁচটি লটের এস্টিমেট প্রস্তুত করে গত ১৫ মে ২০২৩ গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পায় রশিদ মোল্লার ‘মেসার্স সিলভা এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘মেসার্স অনামিকা এন্টারপ্রাইজ’ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। 

সরেজমিন সাভার হাইওয়ে থানা ও ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখা যায়, থানার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় ৭ ফিট দেয়াল ধসে পড়া, দেয়াল ইটের গাঁথুনি দিয়ে পুরো সীমানাপ্রাচীর রঙের আঁচড় দিয়েছে। এছাড়া এস্টিমেট অনুযায়ী অন্য কোনো কাজ করার চিত্র দেখা যায়নি। প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে। ফাঁড়ির পশ্চিম পাশের পাঁচ ফিট দেয়াল ধসে পড়া ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু ওই পাঁচ ফিট দেয়াল সংস্কার করে রঙতুলির আঁচড় দেওয়া হয়েছে। এখানেও এস্টিমেট অনুযায়ী কোনো কাজের চিত্র দেখা যায়নি। 

ফাঁড়ি ইনচার্জ হুমায়ন কবির প্রতিবেদকের হাতের এস্টিমেট দেখে বলেন, আমার জানা মতে এখানে কোনো সংস্কার কাজ হয়নি। শুধু সীমানার দেয়ালে রঙের আঁচড় দেওয়া হয়েছে। আর ব্যারাক ভবন-তো আপনি নিজেই দেখতে পাচ্ছেন। ব্যারাকের সিলিংগুলো ঝুলে আছে। যে কোনো সময় ধসে পড়ার অবস্থা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রশিদ মোল্লা ও রশিদ মোল্লা ‘রনি’ এটি যৌথ পরিকল্পনার একটি অংশ। মূলত, পুলিশ সুপার ও ঠিকাদার জেনে শুনে এসব কাজে যুক্ত হয়েছেন। কারণ টেন্ডার যাচাই-বাছাই কমিটির এসব বিষয়ে দৃষ্টিতে আসার কথা থাকলেও তা আসেনি। সাফ কথা ‘রনি’র প্যাঁচে ‘মোল্লা’রা কোটি টাকার ফাঁদ পেতেছেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর পুলিশ সুপারের সঙ্গে আঁতাত করে ঠিকাদার রশিদ মোল্লা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি সংস্কার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। টেন্ডারে অন্য কোনো ঠিকাদারের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে পুলিশ সুপার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত ৫ বছরে অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম