পবা উপজেলায় আলোড়ন
ইউএনওর ভাই কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত
রাজশাহীর পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত সরকারি বিধিবিধানের তোয়াক্কা করছেন না। গ্রাম থেকে আপন চাচাতো ভাই রাজীব রনককে ঢাকায় এনে তাকে দিয়ে প্রায় কোটি টাকার নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩০টি বাড়ি নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। এছাড়া রাজীব রনক ডরমেটরি এবং শিল্পকলা একাডেমি অফিস সংস্কারের কাজও করছেন। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে ৩০টি বাড়ি নির্মাণে যেসব ইট লেগেছে তা একটি ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে ঘুস হিসাবে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিনিময়ে ইউএনওর বিরুদ্ধে ওই ইটভাটার মালিককে ৩টি পুকুর খননের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই বাড়ি নির্মাণ কাজ দরপত্র প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে হয় না। এটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনই কাজটি বাস্তবায়ন করে। এই কমিটির আহ্বায়ক ইউএনও। আর সদস্য সচিব হচ্ছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। এছাড়া কমিটিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং উপজেলা প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার থাকার কথা। জানা গেছে, উপজেলার কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় অনেক আগেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩০টি বাড়ি নির্মাণ হয়। বাড়িগুলো ছিল টিনের তৈরি। এগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের অর্থ আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। প্রতিটি বাড়ির জন্য বরাদ্দ ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। এই কাজ শুরু হয়েছে গত অর্থবছরের জুনে। বর্তমানে কাজ প্রায় শেষের দিকে। কাজ হচ্ছে নিুমানের সামগ্রী দিয়ে। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বাড়ি নির্মাণে যে পিলার রয়েছে সেটিতে বাইরে থেকে একটি করে রড দেখা যাচ্ছে। এখানে কমপক্ষে চারটি রড দেওয়ার কথা। পিলারের নিচে পুঠিং ঢালাই দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেটিও করা হয়নি। নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই এসব পিলার ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বরাদ্দের অর্ধেক অর্থও ব্যয় হয়নি। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ইউএনও হাসনাতের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাই উপজেলায়। প্রায় এক বছর আগে তিনি পবার ইউএনও হিসাবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরই তিনি গ্রাম থেকে চাচাতো ভাই রাজীব রনককে আনেন। রনক এখন উপজেলা ক্যাম্পাসে ইউএনওর সরকারি বাসভবনেই থাকেন।
উপজেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩০টি বাড়ি নির্মাণের জন্য ইটও ঘুস নেওয়া হয়েছে পবার হরিয়ান এলাকার একটি ইটভাটা থেকে। ওই ইটভাটার ভেতর মালিক এবং অন্য এক ব্যক্তিকে তিনটি পুকুর খনন করতে দেওয়ার বিনিময়ে ওই ইট ঘুস নেওয়া হয়। যোগাযোগ করা হলে ইটভাটার মালিক মো. রুনু মোবাইল ফোনে কথা বলতে চাননি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িগুলো নির্মাণের ব্যাপারে মোবাইল ফোনে প্রথমে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে কৌশলে কথা হয় ইউএনওর চাচাতো ভাই রনকের সঙ্গে। তিনি তখন স্বীকার করেন, ঘরগুলো তিনিই নির্মাণের কাজ করছেন। এতে অন্য কেউ নেই। পরে পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে রনক বলেন, চাচাতো ভাইয়ের কাছে বেড়াতে এসে তিনি শুধু কাজটি দেখাশোনা করছেন। নিুমানের কাজের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কর্মকর্তারা দেখবেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ৩০টি বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে কোনো সভা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বাশির কোনো মন্তব্য করতে চাননি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি হয়েছে কিনা সে বিষয়েও তিনি কোনো কথা বলবেন না বলে জানিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি হলে এই কর্মকর্তারই সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালনের কথা। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বাদ দিয়ে চাচাতো ভাইকে দিয়ে কাজ করানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত বলেন, ‘এটা সত্য নয়। কাজ কমিটির মাধ্যমেই করা হচ্ছে। আমার চাচাতো ভাই কাজ করবে কেন? ও কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। কাজ করছে মিস্ত্রি।’ ডরমেটরি ও শিল্পকলা একাডেমি সংস্কার চাচাতো ভাইকে দিয়ে করানোর অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘এটাও সত্য না। কে বলেছে এসব কথা?’ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘কাজটা যদি ঠিকাদারের মাধ্যমে হতো এবং ইউএনওর চাচাতো ভাই যদি যোগ্যতাসম্পন্ন বৈধ ঠিকাদার হতেন তাহলে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু যেহেতু কাজটি দরপত্র প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে না হলেও তিনি চাচাতো ভাইকে দিয়ে কাজ করাতে পারেন না। এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেলে আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’