Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

রাজশাহীর ১৪ পৌরসভা

ভুয়া প্রকল্পে লোপাট হাজার কোটি টাকা

বিপুল বরাদ্দেও হয়নি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভুয়া প্রকল্পে লোপাট হাজার কোটি টাকা

ফাইল ছবি

বছরের পর বছর রাজশাহীর ১৪ পৌরসভার সাবেক ও সদ্য সাবেক মেয়ররা একেকজন ছিলেন দুর্নীতির বরপুত্র। মেয়র ছাড়াও পৌরসভাগুলোর সচিব ও প্রকৌশলীরাও সেই সুযোগে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। বরাদ্দের বেশির ভাগ অর্থ ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে লোপাট হয়েছে। পৌরসভার সাবেক মেয়ররা যেমন টাকার কুমির হয়েছেন, তেমনই পৌরসভার একশ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারীও ভাগেযোগে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। পৌরসভাগুলোতে নাগরিক সেবা শূন্য হলেও দিনে দিনে মোটাতাজা হয়েছে মেয়র, সচিব, প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের একাংশ। রাজশাহীর ১৪ পৌরসভার সব কটির বেহাল চিত্র।

রাজশাহীর প্রথম শ্রেণির পৌরসভা গোদাগাড়ী। এ পৌরসভার পলাতক মেয়র অয়েজুদ্দিন বিশ্বাস ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর উপনির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন। দায়িত্ব নিয়েই প্রথম সভাতেই ২৫টি ভুয়া প্রকল্প সম্পন্ন দেখিয়ে ২৫ লাখ টাকা লোপাট করেন। এরপর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থ লোপাট করেন সহকারী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান ও হিসাবরক্ষক হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে মিলেমিশে। সাবেক মেয়র অয়েজুদ্দিন বিশ্বাস হাট ঘাট ও সড়ক টোলের দুই কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে পৌরসভার একাধিক কাউন্সিলর অভিযোগে বলেছেন। সাবেক মেয়রের ছেলে রায়হান বিশ্বাসকে বিকল্প লাইসেন্সে পৌরসভার অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ দেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, অয়েজুদ্দিন বিশ্বাস আড়াই বছরের মেয়াদে এলাকায় ৪৫ বিঘা জমি কিনেছেন। গোদাগাড়ী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী কাম সচিব সারওয়ার জাহানও বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

রাজশাহীর কেশরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র শহীদুজ্জামানও দায়িত্বকালীন দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি কেশরহাট পৌরসভার কাউন্সিলররা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিভভাবে সাবেক মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন তহবিলের ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনেন। সাবেক মেয়র শহীদ একাধিক দফায় মেয়র হয়ে অধিকাংশ টাকা ভুয়া উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে লোপাট করেছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আত্মগোপনে রয়েছেন শহীদ।

রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক মণ্ডল দুর্নীতিতে ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। দরপত্র আহ্বান না করেই নিজেই ঠিকাদার সেজে পৌরভবন নির্মাণ করেন যেনতেন প্রকারে। পরে পৌরভবন নির্মাণের বাজেট বাবদ কোটি টাকা তুলে নেন। ১৯ মার্চ পৌরসভার কাউন্সিলররা রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের তদন্ত করেন স্থানীয় সরকার বিভাগ। তদন্তে দেখা যায় মালেক মণ্ডল মেয়র হিসাবে অর্থ ব্যয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। অধিকাংশ খাতের বিপুল টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ গড়েন। ১২ জুন সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক মণ্ডলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মঙ্গলবার জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মালেক মণ্ডলকে গ্রেফতার করে।

রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার বিতর্কিত সাবেক মেয়র মুক্তার হোসেন ছিলেন দুর্নীতি অনিয়মে চরম বেপরোয়া। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের প্রশ্রয়ে সর্বত্র বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেন। ২০২২ সালের ৬ জুন রাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মুক্তারের পিয়াদা গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৯৬ লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র এবং মাদক উদ্ধার করেন। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় মুক্তারকে। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে কিছুদিন পরেই জামিনে বেরিয়ে এসে মুক্তার আবার মেয়রের চেয়ারে বসেন। ৫ আগস্ট থেকে মুক্তার হোসেন আত্মগোপনে আছেন। সম্প্রতি মুক্তারের বিরুদ্ধে পৌরবাসী দুদকে র্দুীতির অভিযোগ দিয়েছেন।

রাজশাহীর তাহেরপুর পৌরসভাকে জলবায়ু ও পরিবেশ খাতের ১৩ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প দেওয়া হয়। কিন্তু সাবেক মেয়র আবুল কালাম আজাদ প্রকল্পের কাজ না করে বেশিরভাগ অর্থই লোপাট করেন। কালাম অন্য খাতগুলো থেকে আহরিত বিপুল রাজস্ব ও উন্নয়ন প্রকল্পের টাকাও লোপাট করেন বলে তাহেরপুর পৌরবাসীর অভিযোগ। চলতি বছর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাজশাহী-৪ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচত হন কালাম। পরে নিজের স্ত্রী শায়লা খন্দকারকে বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র করেন। কালাম পুলিশের তালিকাভুক্ত একজন সন্ত্রাসীও।

রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার দুই মেয়াদের মেয়র আক্কাছ আলীর বিরুদ্ধে পৌর তহবিল ও উন্নয়ন খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। ২২ জুন মেয়র আক্কাছের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে মানববন্ধন চলাকালে আক্কাছের সন্ত্রাসীর বাহিনীর হামলায় বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নিহত হন। এ মামলায় আক্কাছ গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন।

রাজশাহীর তানোর ও মুণ্ডুমালা পৌরসভার সদ্য সাবেক ও আগের মেয়রদের বিরুদ্ধেও বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া, চারঘাট, পুঠিয়া, কাটাখালী, দুর্গাপুর ও কাকনহাট পৌরসভার সদ্য সাবেক ও সাবেক একাধিক মেয়রের বিরুদ্ধেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুঠিয়া পৌরসভায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়েছে। এডিপির অর্থ ব্যয়ে পিপিআর নীতিমালা অনুসরণ না করে ঢালাও প্রকল্প গ্রহণ করে বিপুল অর্থ তছনছের অভিযোগ প্রতিবেদন আকারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপ-সচিব) আশরাফুল ইসলাম জানান, পৌরসভাগুলোতে অর্থ ব্যয়ে চরম বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে। মেয়ররা তদবির করে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প এনেছেন, তবে সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে তার কোনো স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে পিপিআর নীতিমালা লঙ্ঘনের বহু ঘটনা সামনে আসছে। আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি পৌরসভার বিষয়ে তদন্ত করেছি ও মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম