Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

দেশটা ঠিক হলেও আমরা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম

ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের, অর্থকষ্টে ভুগছেন অনেকে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশটা ঠিক হলেও আমরা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম

ছাত্র আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন

বিশ জুলাই সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সেলুনকর্মী রাকিব হোসেন। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল, জি-২৪ নং বেড) ভর্তি করা হয়। বুলেটবিদ্ধ ক্ষতস্থানে পচন ধরায় চিকিৎসকরা রাকিবের বাম ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলেছেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সি রাকিব পা হারানোর কষ্ট কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। বুধবার দুপুরে এই প্রতিবেদক রাকিবের বিছানার পাশে গিয়ে পরিস্থিতি জানতে চাইলে হু-হু করে কেঁদে উঠে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি আর কখনোই নিজ পায়ে ভর করে হাঁটতে পারব না স্যার! সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে! একটু দাঁড়াতে চাইলেও অন্যের সহায়তা আর ক্র্যাচের ওপর ভরসা করতে হবে। দেশের সবকিছু ঠিক (স্বাভাবিক পরিস্থিতি) হয়ে গেলেও আমি তো পরাধীন হয়ে গেলাম স্যার!

এ সময় পাশে বসা রাকিবের মা রিনা বেগম আঁচলে চোখের পানি লুকিয়ে ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি যুগান্তরকে জানান, গতকালও (মঙ্গলবার) ওটিতে নিয়ে কাটা জায়গায় নতুন করে সেলাই দিয়েছে। এখন ডিউটি ডাক্তার ছুটি দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ডাক্তাররা বলছেন, অপারেশনের পর তারা রোগীকে ভর্তি রাখে না। এরপরও থাকতে চাইলে, কাটা জায়গা ইনফেকশন হলে, পায়ের আরও অংশ কেটে ফেলতে হতে পারে! তখন চিকিৎসকরা দায় নেবন না।

রিনা বেগম আরও বলেন, রাকিবের বাবার ছোট্ট একটি মুদি দোকানের আয়ে পুরো সংসার চলে, ঘটনার পর এখন পর্যন্ত ১৩ ব্যাগ রক্ত লাগছে। গতকালও এক ব্যাগ দিয়েছি। ছেলে এখনো বসতে পারে না। শরীরে শক্তি পায় না, পায়খানা-প্রসাব পর্যন্ত বিছানায় করে। এখান থেকে বের করে দিলে কোন হাসপাতালে নেব, ইনফেকশন হলে কোথায় যাব, চিকিৎসার টাকা কোথায় পাব সেই চিন্তায় ঘুম আসছে না।

আমার পা হারানোর বিনিময়ে দেশটা বেঁচে গেছে : পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ এর জি-১৪ নম্বর বিছানায় বাম হাঁটুর ওপর থেকে কাটা পা নিয়ে কাতরাতে দেখা যায় ২৭ বছরের যুবক জাকির শিকদারকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুলশানে একটি কাপড়ের শোরুমে কাজ করতেন। থাকতেন বাড্ডায়। ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। বাড্ডার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়ে পুলিশ। ওই সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দৌড় দিলে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা বাড্ডার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক ব্যান্ডেজ বেঁধে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন। অবস্থা গুরুতর দেখে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসকরা জানান, বুলেটের আঘাতে পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। ভর্তির তিন দিনের মাথায় পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

জাকির জানান, ‘তার বাবা মারা গেছেন ২০০৭ সালে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন। ছোট ভাই উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী, বোন স্কুল পড়ে। চার সদস্যের পরিবারের তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। আমার পা হারানোর বিনিময়ে দেশটা বেঁচে গেছে এটা সবচেয়ে বড় পাওয়া। তবে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম।’

জাকিরের মা হনুফা বেগম বলেন, পরিবারের একমাত্র আয় যার মাধ্যমে হয় ছেলে এখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। একটা পা নেই। বেশি পড়াশোনা জানা নেই। নেই জমিজমাও। ছেলের সামান্য বেতনই একমাত্র ভরসা ছিল। এখন যতদিন বাঁচে পরাধীন মানুষের মতো অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। আমার ছেলের এই অবস্থা যারা করেছে তাদের বিচার চাই। তিনি বলেন, এখন কেমনে ঘরভাড়া দেব কীভাবে? খাব কী? একদিকে নিজের সমস্যা, অন্যদিকে ছেলের এমন পরিণতি। আমরা কীভাবে বাঁচব।

বাম চোখের আলো নিভে গেল মাসুদের : গত ৪ আগস্ট সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলের সম্মুখভাগে ছিলেন ওসমানী মেডিকেল কলেজের (সিওমেক) শিক্ষার্থী মাহমুদ। ওই সময় পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন মাহমুদ এবং গুলি প্রবেশ করে তার বাঁ চোখে। পরে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য পরে রাজধানীর ঢাকার ভিশন আই হসপিটালে ভর্তি করে প্রাথমিক অস্ত্রোপচার করা হয়। মঙ্গলবার রাতে মাহমুদের বাঁ চোখে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ চেষ্টার পর স্পর্শকাতর স্থান হওয়ায় এখনো গুলি বের করা যায়নি। গুলির আশপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার আরও ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন। বাঁ চোখে আর কখনো পৃথিবী দেখতে পারবেন কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মাহমুদের সবশেষ শারীরিক পরিস্থিতি জানতে বুধবার এই প্রতিবেদক মুঠোফোনে কল করলে তার এক স্বজন জানান, প্রায় সময় মাহমুদ আক্ষেপ করছে আর বলছে, স্বৈরাচার হাসিনার পতন হয়েছে। দেশের মানুষ মুক্তি পেয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু তিনি চোখের আলো হারিয়ে অনেকটা পরাধীন হয়ে গেছেন।

জানতে চাইলে পঙ্গু হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিমুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পঙ্গু হাসপাতালে গত ১৫ জুলাই থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬৪২ জন ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনকে মৃত অবস্থায় এবং একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বর্তমানে ১৩৮ জন ভর্তি আছেন। ভর্তি রোগীদের ৩৯১ জন বুলেটবিদ্ধ এবং বাকিরা বিভিন্নভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন।

তিনি আরও বলেন, ভর্তি রোগীদের সংক্রমণ ঠেকাতে আটজনের পা এবং একজনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আরও দু-একজনের পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। যাদের শরীরের কোনো অঙ্গ কাটা পড়ছে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব নয়। অন্যদের সহায়তা নিয়ে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে হবে।

তবে আমরা রোগীদের চিকিৎসা পুনর্বাসনের জন্য হাসপাতাল থেকে ক্র্যাচ, ব্রেস, বেল্ট, হুইল চেয়ারসহ বিভিন্ন উপকরণ দিচ্ছি। একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম