কাটতে হচ্ছে অঙ্গ, কেউ ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে
ঢামেকে চিকিৎসাধীন আরও ১ জনের মৃত্যু
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধদের বড় অংশ শ্রমিক কিংবা দিনমজুর। তারা হাসপাতালে-হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। জীবন রক্ষার্থে তাদের কারও কাটতে হচ্ছে হাত-পা কিংবা অন্য কোনো অঙ্গ। আর কেউ কেউ জীবনযুদ্ধে হেরে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পঙ্গু হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
আহত রোগীদের কারও বুকে, পেটে, কারও হাতে কিংবা পায়ে, কারও মাথায় গুলির জখম। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ রোগী। চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও বাঁচাতে পারছেন না। হাসপাতালগুলোতে যারা সেরে ওঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, শুধুই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার আকুতি তাদের।
শনিবার বিকাল ৪টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের বারান্দায় গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছেন ইয়াসমিন বেগম। ‘আল্লাহ আমার ছেলের কী দোষ ছিল। আমার ছেলেটাকে কেন ওরা এভাবে গুলি করে মারল? আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি, দিন খাই। আমরা তো রাজনীতি বুঝি না! আমার ছেলে তো আন্দোলনে যায়নি। কেন আমার ছেলেকে গুলি করে মারল’-এসব কথা বলে বিলাপ করছিলেন তিনি।
গত ১৯ জুলাই উত্তর বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ার এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তার ছেলে ১৭ বছর বয়সি ইয়ামিন চৌধুরী। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় মারা গেছে সে। ইয়াসমিন বেগম যুগান্তরকে জানান, ইয়ামিন উত্তর বাড্ডার একটি পোশাক কারখানায় হেলপার হিসাবে কাজ করত।
মাসে বেতন পেত ৭ হাজার টাকা। গত ১৯ জুলাই গার্মেন্ট ছুটি হয়ে গেলে ইয়ামিন হেঁটে বাসায় ফিরছিল। পথে সুবাস্তু টাওয়ারের কাছে পুলিশের গুলিতে সে আহত হয়। তার পেটের ডানপাশে এবং ডানহাতে গুলি লাগে। ছেলের মৃতদেহ ঢামেক জরুরি বিভাগের মর্গে রেখে ইয়ামিনের বাবা রতন চৌধুরী ছেলের মৃতদেহের আইনি প্রক্রিয়া সারতে শাহবাগ থানায় গেছেন। ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থানার কাঞ্চনপুরে নিয়ে যাবেন ছেলের লাশ।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, শনিবার পর্যন্ত ঢামেক থেকে ৮৮ জনের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর আটজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২১৪ জন। ঢামেক হাসপাতালের ১০০, ১০১, ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের বেডে, মেঝেতে সারি সারি গুলিবিদ্ধ রোগী। কর্তব্যরত নার্সরা জানিয়েছেন, এসব রোগীর একটা বড় অংশ কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ।
একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এসব রোগীকে সারিয়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। তারপরও অনেক রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন বরিশালের দৌলতখান থানার কাজীরহাটের ফরিদ হোসেন (৪০)।
রাজধানীর মানিকনগর এলাকায় থেকে মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রী শিরীনা আক্তার বাসাবাড়িতে কাজ করেন। ফরিদ হোসেন জানান, গত ১৯ জুলাই দুপুরে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে মানিকনগরের অদূরে বিশ্বরোড ঢাল নামক স্থানে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার পেটে বেশ কয়েকটি গুলি লাগে। অস্ত্রোপচার করা হলেও এখনো পেটের ভেতরে রয়ে গেছে একটি গুলি। স্ত্রী শিরীনা আক্তার যুগান্তরকে জানান, তার এক ভাই গ্রাম থেকে ধারদেনা করে টাকা পাঠাচ্ছে। সেই টাকা দিয়ে চলছে ফরিদের চিকিৎসা খরচ। তিনি বলেন, আমার স্বামী সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে কাজে গেল, আর ফিরল গুলিবিদ্ধ হয়ে। জানি না, কবে সে সেরে উঠবে।
মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় থেকে দিনমজুরির কাজ করেন হাবিবুর রহমান (২৮)। তিনি গত ১৯ জুলাই চান হাউজিং এলাকায় আন্দোলনকারী এবং পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়েন। এ সময় পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। তার পেটে এবং পিঠে দুই শতাধিক ছররা গুলিবিদ্ধ হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনি। তার মতো আরও অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কাঁচপুরের একটি এমব্র্রয়ডারি কারখানায় কাজ করত নাদিম হোসেন (১৭)। গত ২০ জুলাই বিকালে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। এ সময় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন নাদিম। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল ও পরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। নাদিমের ডানপায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার পা কেটে ফেলেছেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
নাদিমের বাবা রিকশাচালক দুলাল হোসেন যুগান্তরকে জানান, তাদের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া থানার খাজুরিয়া লক্ষ্মীপুর গ্রামে। নাদিম চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অভাবের সংসারে তার লেখাপড়া বন্ধ করে এমব্রয়ডারি কারখানায় চাকরিতে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ছেলেটার পা কেটে ফেলতে হলো। সুস্থ হলে এক পা নিয়ে এই ছেলে কীভাবে আয় করে খাবে? দুলাল হোসেন জানান, এ পর্যন্ত নাদিমের চিকিৎসায় ৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।
পঙ্গু হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, যেসব রোগী পায়ে কিংবা হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাদের রক্তনালি বা ধমনি ছিঁড়ে গেছে। তাদের এসব অঙ্গ কাটতে হয়েছে। না কাটলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে মাংসে পচন ধরবে। তখন রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে পঙ্গু হাসপাতালে ১৭শর মতো রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৮৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে এ হাসপাতালের ওয়ার্ডে কিংবা কেবিনে। তাদের মধ্যে ২৫০ জন গুলিবিদ্ধ। গুলিবিদ্ধদের ২০ জনের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে।