আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলও খাটে
ভাড়ায় মেলে আসামি
কোনো আইনজীবী ভাড়া করা আসামির পক্ষ নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে -সভাপতি, ঢাকা বার
ফাইল ছবি
ঢাকার আদালতে বিচারাধীন ও বিচার নিষ্পত্তি হওয়া একাধিক মামলায় জড়িত মূল আসামির পরিবর্তে নকল বা প্রক্সি আসামির জেল খাটার তথ্য মিলেছে। এসব আসামি মূলত ভাড়ায় খাটে। প্রক্সি আসামি হিসাবে যারা জেল খাটেন তাদের পরিবারের দায়িত্ব নেন মূল আসামি। এ ছাড়া তার অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচও বহন করেন তিনি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে চলতি বছরেই আসামি ভাড়ায় খাটার তিনটি স্পর্শকাতর ঘটনার সন্ধান মিলেছে। এসব আসামি সংগ্রহ ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার পেছনে এক শ্রেণির দালাল কাজ করে। এমনকি আসামিপক্ষের আইনজীবীর সম্পৃক্ততারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে জড়িত একজন আইনজীবী অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি বলেছেন, আত্মসমর্পণকারী আসামির বিষয়ে ভালোভাবে জেনে আদালতে তুলতে হবে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতির মতে, ভাড়া করা আসামির পক্ষ নিলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতারণার এক মামলায় জড়িত আসামির নাম আসাদুজ্জামান খোকন। মামলার বাদী সিরাজুল ইসলাম। জানা যায়, খোকন ব্যবসার জন্য হাত ঘড়ির একটি লট (অনেকগুলো ঘড়ি) একসঙ্গে কিনবেন বলে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে পরিচিত ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঘড়ির লট কিনতে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম লাগবে বলেও জানান খোকন। ২০২২ সালের ২ আগস্ট ৪৫ লাখ টাকা জোগাড় করেছেন বলে সিরাজুল ইসলামকে জানান। ওইদিন খোকনের বারিধারার অফিস থেকে বের হওয়ার পর ডিবি পুলিশ মামুনুর রশিদ নামে একজনকে আটক করে। এসময় তার জবানবন্দি মতো, খোকন ও শফিককে আটক করা হয়। অভিযোগ ছিল, খোকন এর আগেও ব্যবসার কথা বলে একই কায়দায় আব্দুল মজিদ নামে একজনের সঙ্গে প্রতারণা করে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে সিরাজুল ইসলাম খোকনসহ আটজনের বিরুদ্ধে ক্যান্টমেন্ট থানায় প্রতারণার মামলা হয়।
মামলার আসামি আসাদুজ্জামান খোকন আদালতে আত্মসমর্পণ না করে ৩৫ হাজার টাকায় একজন নকল আসামি জোগাড় করেন। গত ২৪ জুন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালতে আসাদুজ্জামান খোকন নাম দিয়ে নাসিম শেখ নামের ওই নকল ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। তার জামিন শুনানির এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সন্দেহ হয়, এই আসামি নকল হতে পারে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, খোকন তাকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন, তার পরিবর্তে যেন আত্মসমর্পণ করে। জামিন না হলে বা জেলে গেলে তার পরিবারের দায়িত্বও নেবেন বলে খোকন তাকে আশ্বস্ত করেন। এ ঘটনায় প্রতারক আসাদুজ্জান খোকন, নকল আসামি নাসিম শেখ ও খোকনের আইনজীবী শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রতারণার মামলা করে পুলিশ। মূল আসামি খোকনের বিরুদ্ধে এখনো একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান খোকনের আইনজীবী শহিদুল যুগান্তরকে বলেন, ‘সে (নাসিম) যে মূল আসামি নয় আমি জানতাম না। এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।’
ভাড়ায় সাজা খাটেন আল আমিন : ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে ডেমরার আমুলিয়া রোডে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা একটি মাইক্রোবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অবরোধকারীদের বাধা দিলে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৪৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। এ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি শিপু মিয়া। গত ৪ মার্চ আল আমিন নামে এক ব্যক্তি ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে আসামি শিপু মিয়ার হয়ে সাজা খাটতে রাজি হন।
জানা যায়, আল আমিন তিন বছর আগে সানারপাড় মৌচাকের ‘সুস্থ জীবন’ মাদকাসক্ত ক্লিনিকে ওয়ার্ড বয় হিসাবে কাজ করতেন। বর্তমানে হাসপাতালটি বন্ধ আছে। হাসপাতালের মালিক ফিরোজ মিয়া ফোন করে হাসপাতাল চালু করার জন্য আল আমিনকে আদালতে দাঁড়াতে হবে বলে আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে যান। আইনজীবীর চেম্বারে শিপু নামীয় এনআইডিতে আল আমিন তার নিজের ছবিযুক্ত এনআইডি বসিয়ে আইনজীবীর পরামর্শে শিপুর নাম নিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সাজা পরোয়ানামূলে প্রাপ্ত বন্দির ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কর্তৃক অনলাইন ডাটাবেজ সংগ্রহ করে দেখতে পান জাতীয় পরিচয়পত্রে আল আমিনের বাবার নাম জালাল বেপারী। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে বিষয়টি অবহিত করলে আদালত বন্দির উপস্থিতির জন্য ৪ মার্চ দিন ধার্য করেন। যথারীতি সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আদালতে হাজির করা হলে তার নাম মো. আল আমিন বলে জানান। আল আমিন ডেমরা থানার ওই মামলায় ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে দণ্ডিত শিপু মিয়ার স্থলে সাজা ভোগ করছেন বলে প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেন। আল আমিন আদালতকে বলেন, আমি অত্যন্ত গরিব একজন মানুষ। ফিরোজের মাধ্যমে ৪০ হাজার টাকার প্রলোভনে পড়ে ওই মামলার মূল আসামি শিপু মিয়ার দুই বছর ছয় মাসের সাজা ভোগ করার জন্য এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যাই। এ ধরনের কাজের জন্য আদালতের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। পরে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. আনোয়ারুল হক রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় বাদী হয়ে আল আমিন, শিপু মিয়া ও ফিরোজের নামে একটি মামলা করেন।
যুবলীগ নেতার হয়ে জেল খাটেন মিরাজুল : ২০২০ সালের আগস্টে উত্তরার একটি বাসায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ আনোয়ার হোসেন নামে একজনকে আটক করে। এসময় পালিয়ে যান চক্রের মূলহোতা যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান। এ ঘটনায় দু’জনকে আসামি করে মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় পলাতক নাজমুল হাসানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।
কিন্তু দণ্ডিত যুবলীগ নেতা নিজে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যাওয়ার পরিবর্তে মিরাজুল ইসলাম নামে একজনকে ভাড়া করেন। মিরাজুল যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান হয়ে জেলে যান। সাত বছর সাজা খাটার জন্য মিরাজুলের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে চুক্তি করেন যুবলীগ নেতা। বিষয়টি জানাজানি হলে বিচারিক আদালত নাজমুলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গত ১৩ মে যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান আদালতে আত্মসমর্পণ করলে ঢাকার ৮ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আমিনুল ইসলামের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোর্শেদ খান যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা আশা করি বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা আদালতে এ বিষয়ে শুনানি করেছি। জেলখানাগুলোকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামি ঢোকার সময় ফিঙ্গার দিয়ে ঢুকবে, যাতে তার এনআইডির সঙ্গে তথ্য যাচাই করা যায়।
আদালতে ভাড়ায় আসামির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, এই ঘটনাগুলো আমাদের নজরের বাইরে। আইনজীবী সবসময় তার আসামিকে চেনেনও না। সবাইকে তো চেনা সম্ভব নয়। এনআইডি কার্ড যদি মিথ্যা হয় সেটা তো আইনজীবীরা যাচাই করতে পারবেন না। তবে, আমরা এ ব্যাপারে সচেতন আছি। কোনো আইনজীবী যদি জেনেশুনে এমনটি করেন, আর এটা প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার সনদ বাতিলের জন্য বার কাউন্সিলে আবেদন করা হবে।
ঢাকার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে তা সত্য নয়। হঠাৎ এমন হয়ে যায়। আসামি ধরা পড়ে, আবার শাস্তিও হয়। এগুলো আটকাতে হলে যারা আত্মসমর্পণ করতে আসে তাদের ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। আদালত, পাবলিক প্রসিকিউটরসহ আইনজীবীদের সচেতন হতে হবে-যোগ করেন তিনি।