৫ বছরে সাজা মাত্র ৩১ মামলায়, কারও মৃত্যুদণ্ড হয়নি
মানব পাচার মামলায় খালাস ৯৪ শতাংশ
সারা দেশে অপেক্ষমাণ ৩৭০৪ মামলা, বিচারাধীন ২৮৮০টি
মামুন আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
মানব পাচারের মামলায় নিষ্পত্তি ও সাজার হার খুবই কম। দেশের আদালতে ২০১৯ থেকে ২০২৩-৫ বছরে এ সংক্রান্ত মাত্র ৫২৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ৩১টিতে আসামিদের সাজা হয়েছে। সাজার হার মাত্র ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ মামলার আসামিরাই খালাস পেয়েছেন। খালাস পেয়েছেন ৪৯৭টি মামলার আসামি। ৫ বছরে একটি মামলায়ও কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়নি। ২০১৯ সালে ১৭ মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হলেও পরের ৪ বছরে আর কোনো মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
অপরাধ গবেষক ও আইনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মানব পাচার আইনের মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তির নির্দেশনা রয়েছে। তবে বছরের পর ঝুলতে থাকায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভুক্তভোগীরা এক সময়ে আসামিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হন। মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ কমিয়ে আনতে চাইলে দ্রুত বিচার শেষ করে অপরাধীদের সাজা প্রদান ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
সমাজ ও অপরাধ গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচারের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভিন্ন অবস্থা লক্ষণীয়। এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম, মামলা পরিচালনা, আদালতে সাক্ষীর উপস্থিতি, সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখানো, মামলা প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করাসহ নানা ধরনের অভিযোগ দৃশ্যমান।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২-এ সংঘবদ্ধ মানব পাচারের অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার বিধান আছে। এই আইনের ৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, সংঘবদ্ধ মানব পাচারের অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা অন্যূন ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্যূন ৫ বছর অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। মানব পাচারের মামলার বিচারের জন্য ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশালে সাতটি মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩-৫ বছরে ট্রাইব্যুনালসহ দেশের আদালতগুলোতে মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা পেন্ডিং (বিচারের অপেক্ষায়) রয়েছে তিন হাজার ৭০৪টি। এর মধ্যে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ৮৮০টি। তদন্তাধীন রয়েছে ৮২৮টি মামলা। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৩৪ হাজার ৫০৯ জন। যেখানে ৫ বছরে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫ হাজার ৩৪২ জনকে।
মামলা নিষ্পত্তি ও সাজার তথ্যে বছরভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, সব থেকে বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২০২৩ সালে। ওই বছর ৪৩৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ওই বছর ২১ মামলায় আসামিরা সাজা পায় আর ৪১৫টি মামলার আসামিরা খালাস পান। তবে ওই বছর একটি মামলাতেও কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা হয়নি। ২০২২ সালে ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়, যেখানে সব মামলার আসামিরা খালাস পান। আবার ২০২১ সালে মামলা নিষ্পত্তি হয় মাত্র দুটি। সে বছরও সব আসামি খালাস পান। ২০২০ সালে ১৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। ওই বছর মাত্র একটি মামলায় আসামিদের সাজা হয় আর বাকি ১৩টি মামলার খালাস পান আসামিরা। ২০২৩ সালের আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১৯ সালে। ওই বছর ৩৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়, যেখানে ৯টি মামলায় আসামিরা সাজা পায় ও ৩০টি মামলার আসামিরা খালাস পান।
ঢাকায় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৫টি মামলার আসামিদের সাজা হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে এবং ৯৬ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২২৯টি নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। ২০২২ সালে ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে সাজা হয়েছে ১৪টি মামলায়। ২০২১ সালে ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়, যেখানে সাজা হয়েছে ১৭টি মামলায়। এ ছাড়া ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে সব আসামি খালাস পেয়েছেন।
ঢাকা বারের আইনজীবী তাসমীর উদয় যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে যাওয়া থেকে মানব পাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত অন্তত ৬টি ধাপে অপরাধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে মানব পাচারের শিকার হন, কার মাধ্যমে চক্রের সঙ্গে পরিচয়, ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি; জোরপূর্বক অপহরণ কিংবা কোনো অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পাচার করা হয়েছে কিনা এবং কোন পথে পাচার করেছে-সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা ও দূতাবাসের সঙ্গে পুলিশকে যোগাযোগ করে তদন্ত এগিয়ে নিতে হয়, যা করতে বেশ সময় লাগে। সব প্রক্রিয়ায় যদি শক্ত প্রমাণ না আসে এবং প্রমাণের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকে, তখনই আসামিরা সহজে খালাস পেয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, অনেক মামলার বাদী হয়ে থাকেন অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো শ্রমিক বা কর্মী। সেক্ষেত্রে মামলাটি দণ্ডবিধির প্রতারণা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ এর অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত অপরাধগুলোর আলোকে হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশের অতি উৎসাহী ভূমিকা এবং অনেক সময় আইনজীবীদের ভুলের কারণে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইনে মামলা করার ফলে মানব পাচার আইনের অপরাধের উপাদান অনুপস্থিত থাকে। এটিও খালাস পাওয়ার অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচারের মামলার ভুক্তভোগীরা খুবই অসহায় আর আসামিরা অনেক প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। এ কারণে মামলা থেকে বিচার চলা পর্যন্ত নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে এক সময় আপস করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া আমাদের বিচারকদের ওপর মামলার চাপ অনেক। পাশাপাশি চার্জশিট থেকে শুনানি পর্যন্ত যথাযথ নথিপত্র না থাকা এবং সরকারি আইনজীবীদের আন্তরিকতারও অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচার মামলার সাক্ষী ঠিকমতো আদালতে আসেন না। আবার মামলা তোলার জন্যও আসামিরা চাপ দিতে থাকেন। যথাসময়ে মামলা করা ও ঠিকমতো তদারকির মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা গেলে মামলা নিষ্পত্তি ও আসামিদের শাস্তির হার বাড়বে।
সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, অনেক মামলা চার্জশিটের পর বিচার শুরুর আগেই পাচার চক্র তথা এজেন্টরা আপস-মীমাংসা করে ফেলেন। অন্যদিকে, সিআইডি নিয়মিত পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করলে তারা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আপস করে সেই নথি আদালতে দাখিল করে মামলা তুলে নেয়।
এ বিষয়ে ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম সাজ্জাদুল হক শিহাব যুগান্তরকে বলেন, আদালত কখনো সাজা দেন আবার কখনো আর্থিক দণ্ডও দিয়ে থাকেন। এছাড়া সাক্ষী ঠিকমতো হাজির না হওয়া এবং আপস করার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে গেলে সেটিকে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা বলা যাবে না। মামলা করা থেকে শেষ পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করলে নিষ্পত্তি ও সাজার পরিমাণ আরও বাড়বে।