বরিশালে এমপি-মন্ত্রীবিরোধীদের জয়-জয়কার
ধরাশায়ী আমু-তোফায়েল হাসানাতের ঘনিষ্ঠরা
ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পাড়ায় এটা সম্ভব হয়েছে বলছেন অনেকে
বরিশালে উপজেলা নির্বাচনে গণহারে হেরেছে ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রী সমর্থিত প্রার্থীরা। হেভিওয়েট নেতাদের ঘনিষ্ঠরাও আছেন এই তালিকায়। বিষয়টিকে বহু বছর ধরে দল আর নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা নেতাদের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব হিসাবে দেখছেন সবাই। ভোটাররা এবার নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে বলছেন অনেকে। এমপি-মন্ত্রীরা অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। দলীয় সমর্থন আর প্রতীক না থাকার পাশাপাশি নির্দেশনা অনুযায়ী ভোটের মাঠে নিরপেক্ষ থাকার দাবি তাদের। যদিও এই দাবির সত্যতা মেলেনি। প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে কোনো না কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন তারা। যার নমুনা মিলেছে সবকটি উপজেলায়। তারপরও ৪১ উপজেলার ২১টিতেই হেরেছে তাদের সমর্থিতরা।
রোববার ভোট হওয়া গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াসহ এখানকার ৯ উপজেলার ৭টিতেই হেরেছে এমপি-মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠরা। বরিশাল সদর উপজেলায় সিটি মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত সমর্থিত মাহমুদুল হক খান মামুন এবং সদর আসনের এমপি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থন পাওয়া এস.এম জাকির হেরেছেন ভোটে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, মন্ত্রী মর্যাদায় পার্বত্য শন্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির ঘনিষ্ঠ মনিরুল ইসলামও হেরেছেন এখানে। একইভাবে নিজ নির্বাচনি এলাকা গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় হেরেছে এমপি হাসানাত ঘনিষ্ঠ হারিসুর রহমান ও আব্দুর রইস সেরনিয়াবাত। জেলায় দলের নিয়ন্ত্রক হিসাবে পরিচিত এই নেতার আরও দুই ঘনিষ্ঠজন খালেদ হোসেন স্বপন ও তারিকুল হাসান খান মিঠু হেরেছে বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলায়। তবে বাকেরগঞ্জ, বানারীপাড়া ও উজিরপুরে জিতেছে তার ঘনিষ্ঠরা। বাকেরগঞ্জে স্থানীয় এমপি হাফিজ মল্লিকের সমর্থন পাওয়া মতিউর রহমান বাদশা হেরেছে রাজীব তালুকদারের কাছে। হিজলায় সংরক্ষিত আসনের এমপি ড. শাম্মি আহম্মেদ সমর্থিত দিপু সিকদারের কাছে হেরেছে স্থানীয় এমপি পঙ্কজ দেবনাথ সমর্থিত নজরুল ইসলাম রাজু। যদিও কাউকে সমর্থন দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি এমপি হাসানাত। দলীয় নির্দেশনা মানার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রার্থীরা সবাই-ই আওয়ামী লীগের। এখানে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ ছিল না। আমি ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেছি। তাদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।
এমপি তোফায়েলের আপনজনরা হেরেছে ভোলায় : জেলার ৭ উপজেলার ৫টিতেই স্থানীয় এমপিদের ঘনিষ্ঠরা জিতলেও হেরে গেছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য প্রভাবশালী নেতা তোফায়েল আহমেদ এমপির কাছের নেতারা। সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন শেষে ফুটে উঠেছে এ চিত্র। সদর উপজেলায় তোফায়েল আহমেদের প্রার্থী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করা মোশাররফ হোসেন হেরেছেন। বোরহানউদ্দিনে হেরেছেন তোফায়েলের ভায়রা আবুল কালাম আজাদ। লালমোহনে এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন’র ঘনিষ্ঠ আকতার হোসেন হেরেছেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা আক্তারুজ্জামান টিটভ’র কাছে। তবে তজুমদ্দিনে জিতেছেন এমপি শাওনের ঘনিষ্ঠ ফজলুল হক দেওয়ান। এছাড়া দৌলতখান-বোরহানউদ্দিন-চরফ্যাশন এবং মনপুরায় জয়ী হন ওইসব এলাকার দুই এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ও আলী আজম মুকুল ঘনিষ্ঠরা। সমর্থনের বিষয়টি গোপন না থাকলেও প্রকাশ্যে অবশ্য কখনোই কিছু বলেননি এমপি তোফায়েল। কাউকে সমর্থন দেননি এমনটাই দাবি তার।
ঝালকাঠিতে পরাজয় এমপি আমু সমর্থিতদের : নলছিটি ও ঝালকাঠি সদর উপজেলা নিয়ে নির্বাচনি এলাকা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর আরেক সদস্য আমির হোসেন আমু এমপির। এই দুই উপজেলাতে দুজনকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন তিনি। এর মধ্যে নলছিটিতে হেরে যান তার প্রার্থী তসলিম উদ্দিন চৌধুরী। ঝালকাঠি সদরে আরিফুর রহমানের জয়ে মান খানিকটা বাঁচলেও রাজাপুরে আবার আফরোজা আক্তার হেরে ম্লান করেন তার ইমেজ। তবে কাঁঠালিয়ায় তাকে জয় উপহার দিয়েছেন কাছের জন এমাদুল হক মনির। রাজাপুরে জয়ী হওয়া মিলন মাহমুদ বাচ্চু পান বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা শাহজাহান ওমর এমপির সমর্থন। রোববার অনুষ্ঠিত হয় এখানকার রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার ভোট।
হিসাবের গোলমাল পিরোজপুরে : মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থী হতে নিষেধ করা হলেও নাজিরপুরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সদর আসনের এমপি অ্যাড. শ.ম রেজাউল করিমের সহোদর নূরে আলম সিদ্দিকি শাহিন। ছোট ভাইয়ের পাশাপাশি সদর উপজেলায় তার ঘনিষ্ঠ এস.এম বায়জিদ আহম্মেদও জিতেছেন ভোটে। তবে হেরে গেছেন ইন্দুরকানীর অ্যাড. মতিউর রহমান। একইভাবে সহোদর স্থানীয় এমপি শাহনেওয়াজের প্রকাশ্য সমর্থনের পরও মঠবাড়িয়ায় হেরেছেন রিয়াজ আহম্মেদ। সমর্থন ও ফলাফল প্রশ্নে যাকে নিয়ে এখানে গোল বেধেছে তিনি পিরোজপুর-২ আসনের এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ। নিজ নির্বাচনি এলাকার ভান্ডারিয়া-কাউখালী ও স্বরূপকাঠী তো বটেই, জেলার আরও ৩টি উপজেলায় জিতেছে তার ঘনিষ্ঠরা। এরা হলেন-মঠবাড়িয়ায় বায়জিদ আহম্মেদ খান, সদরে এসএম বায়জিদ ও ইন্দুরকানীতে জিয়াউল আহসান। যদিও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি এমপি মহারাজের। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকাকালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে তার ঘনিষ্ঠদেরকেও সাধারণ জনগণ পছন্দ করেছে বলেই তারা জয়ী হয়েছেন বলেন তিনি।
পটুয়াখালীতে মান বেঁচেছে প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক চিফ হুইপের : নির্বাচনি এলাকা রাঙ্গাবালীর প্রার্থী সাইদুজ্জামান খান মামুনের পক্ষে ভোট চাওয়ার অভিযোগে নোটিশ পেয়ে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত যেতে হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমানকে। মামুনের প্রার্থিতা পর্যন্ত বাতিল করে কমিশন। শেষ পর্যন্ত আদালতের সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে ভোটে জয়ী হন মামুন। রাঙ্গাবালীর পাশাপাশি কলাপাড়াতেও জয়ী হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মোতালেব তালুকদার। বাউফলে সাবেক চিফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ এমপি’র সমর্থন পাওয়া মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে মাঠে নামে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পৌর মেয়র জুয়েলসহ দলের বেশ বড় একটা অংশ। যদিও শেষ পর্যন্ত বিপুল ভোটে হেরে যায় তাদের প্রার্থী মোতালেব হাওলাদার। দশমিনা-গলাচিপায় হেরেছে স্থানীয় এমপি শাহজাদা সাজু’র ঘনিষ্ঠরা। মীর্জাগঞ্জ-দুমকি আর পটুয়াখালী সদরেও জয় পায়নি এমপির সমর্থন পাওয়া প্রার্থীরা।
বরগুনা সদর আসনের তালতলী ও সদর উপজেলায় হেরেছে সেখানকার এমপি গোলাম সরোয়ার টুকুর ঘনিষ্ঠরা। বামনা-বেতাগীতে স্থানীয় এমপি সুলতানা নাদিরা’র ঘনিষ্ঠরা জয় পেলেও পাথরঘাটায় হেরেছে তার প্রার্থী।
এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাড. আফজাল হোসেন বলেন, এবারের নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন ও প্রতীক ছিল না তাই হারজিত নিয়ে খুব একটা ভাবনা নেই আমাদের। তাছাড়া যারা জয়ী হয়েছে তারা তো বাইরের কেউ নয়। এমপি-মন্ত্রীদের সমর্থন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার জানামতে দলের কোনো মন্ত্রী-এমপি কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেননি। যেহেতু সমর্থনের বিষয়টি অপ্রকাশ্য তাই কার লোক হারল কিংবা জিতল সেসব প্রশ্ন অবান্তর বলে আমি মনে করি।