তৃতীয় ও চতুর্থ রেলওয়ে ডুয়েল গেজ লাইন
লেভেল ক্রসিংয়ে ভোগান্তি বাড়বে নগরবাসীর
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকাকে এখন জ্যামের শহর বলা হয়। রিকশা-গাড়িসহ নানা কিসিমের জ্যাম মানুষের কর্মঘণ্টা খেয়ে ফেলছে। সড়কে যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হোক না কেন ভোগান্তি নগরবাসীর পিছু ছাড়ছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এরই মধ্যে রেলপথের সিগন্যালগুলোর কারণে যানজটে ভোগান্তি আরও চরমে ঠেকে। প্রতিদিন রাজধানীর অন্তত ৩০টির বেশি ক্রসিং সিগন্যালের কারণে রেললাইনের দুই পাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
এর মধ্যেই গেণ্ডারিয়া থেকে কমলাপুর এবং কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এই কাজ শেষ হলে ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এমন রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৪৭টি। এ পথে চলমান লাইন স্থাপন সমাপ্ত হলে ক্রসিং ঘিরে শহরের যানজট চরমে উঠবে বলে সবার আশঙ্কা।
ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বর্তমানে রেলের দুই লাইন রয়েছে। এর দুপাশ ঘিরে আরও দুটি থেকে ৪টি নতুন লাইন হচ্ছে। যদিও ৩ বছরের এ প্রকল্পটি এক যুগ ধরে চলছে, যা শেষ হতে ১৫ বছর লাগতে পারে। তবে নতুন করে মহা চিন্তায় ফেলছে তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন। বর্তমানে এ পথ ধরে প্রতিদিন ৭৯ জোড়া (১৫৪টি) ট্রেন চলাচল করে। অর্থাৎ উল্লিখিত ট্রেন চলাচলের কারণে ৩১৬ বার প্রতিটি রেল ক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধক বারগুলো ফেলা হয়। ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৩ মিনিট করে প্রতিবন্ধক বারে সকড়ের দুপাশ বন্ধ থাকলে ৯৪৮ মিনিট (প্রায় ১৫ ঘণ্টা) সড়ক যান বন্ধ থাকে। দুপাশে দীর্ঘ লাইন যানজটের সৃষ্টি হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন চালু হলে এ পথে দ্বিগুণের বেশি ট্রেন চলবে-এমন পরিকল্পনায় প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার পথে।
তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন স্থাপন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী নাজনীন আরা কেয়া যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান লাইনের চেয়ে কোথাও দুটি কোথাও আবার ৪টি নতুন লাইন নির্মাণ হচ্ছে। অর্র্থাৎ নতুন লাইন দিয়ে ক্রসিংগুলো অতিক্রম করেই প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন চলাচল করবে। ওই সময় মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিট পরপর ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক বার ফেলতে হবে। এতে যানজট বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়বে। কারণ ওই রেলপথে আন্ডার-ওভারপাস নেই।
প্রকৌশলী নাজনীন আরা কেয়া আরও বলেন, বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রেললাইনের শতভাগ উপরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, লাইনের উপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েটি এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে-যা যানজট নিরসনে কোনো অবস্থাতেই ওভারপাস করা সম্ভব হবে না। রেলওয়ে এবং এলজিইডি কর্তৃক এমন ক্রসিংগুলোতে (যে ক্রসিংগুলো যানজট সৃষ্টি করে) আন্ডারপাস ও ওভারপাস করার একটি জরিপও হয়েছে। কিন্তু সড়ক ও রেলপথের উপর ঘিরে এক্সপ্রেসওয়ের বর্তমান অবস্থানে আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস করা কীভাবে সম্ভব হবে-প্রশ্ন রাখেন প্রকল্পটির পিডি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গেণ্ডারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত পথের ক্রসিংগুলাতে পরপর প্রতিবন্ধক বার ফেলা হচ্ছে। ওই সময় ৩ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত ক্রসিংয়ের দুপাশে সড়ক যান আটকা পড়ছে। ক্রসিংগুলোর দুপাশে স্থায়ী বাজার এবং বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে। রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর রেলপথকে এমনভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে, যেখানে আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস করা অসম্ভব। এক্সপ্রেসওয়ের উচ্চতা যতটুকু রয়েছে, সেখানে রেলওয়ে ওভারপাস করা একেবারেই সম্ভব নয়। অপরদিকে এক্সপ্রেসওয়ে পিলার এবং সড়কের দুপাশে স্থায়ী বহুতল ভবন হওয়ায় আন্ডারপাস করাও সহজ হবে না।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ৭৯ জোড়া ট্রেন চলাচল করে কমলাপুর স্টেশন হয়ে। শহর ঘিরে ৪৭টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১৬টি সম্পূর্ণ অবৈধ। এসব ক্রসিং ঘিরে ট্রেন চলাচলের সময় ৩ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত বার ফেলে সড়ক যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন তৈরি হলে এ পথে আরও প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন পরিচালিত হবে।
সড়কের যানচালক ও সাধারণ পথচারীদের একটি অংশ বলছেন, শুধু সুস্থ মানুষ কেন, রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সও আটকা পড়ছে ক্রসিংগুলোতে। কখনও ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত গেট আটকে রাখা হচ্ছে। একজন মাইক্রোবাস মালিক জানান, শহরের রেললাইনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়লে ক্রসিংগুলো আরও যন্ত্রণার হয়ে উঠবে। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আরিফুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমরা ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ করছি। সমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে ৫-৭ মিনিট পরপর ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। ওই পথে থাকা লেভেল ক্রসিংগুলো রেলের জন্যও গলার কাঁটা। ট্রেন বাড়ার সঙ্গে ক্রসিং বারও বেশি পড়বে। তাতে নিশ্চয়ই যানজট প্রকট হবে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর ভেতর রেলপথ ঘিরে অবৈধ কিংবা বৈধ এমন লেভেল ক্রসিং পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। বর্তমানে চলা ট্রেনগুলোর কারণে ক্রসিংয়ে যে সময় সড়ক যান চলাচল বন্ধ থাকে, তাতেই যানজট চরমে উঠে। ওই পথে লাইন বাড়ছে। রেল কর্তৃপক্ষ আরও দ্বিগুণ ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। তখন ক্রসিংগুলোতে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বার পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তখন ক্রসিংয়ের দুপাশে যানজট চরমে পৌঁছবে। দুর্ঘটনা বাড়বে। তাতে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়েও প্রকল্পের সুফল মিলবে না। বরং উলটো নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে কখনই গণবান্ধব নয়। ট্রেন শতভাগ গণবান্ধন, যেখানে এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে বেশি মানুষ চলাচল করতে পারে। চাহিদা অনুযায়ী ঢাকা-টঙ্গী রুটে অনন্ত ৬ থেকে ১০টি লাইন বৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে। উপরে এক্সপ্রেসওয়ে, নিচে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারসহ বহুতল স্থায়ী স্থাপন পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। শহরের যানজট নিরসনে আন্ডারপাস ও ওভারপাস সবচেয়ে জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।