সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল স্যালাইন
মিটফোর্ডকেন্দ্রিক অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীরা জড়িত * ডেঙ্গু, করোনা, গরমের সুযোগে সক্রিয় চক্র
মামুন আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে নকল ও ভেজাল খাবার স্যালাইন। করোনা, ডেঙ্গু কিংবা অতিরিক্ত গরমে স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে গেলে সক্রিয় হয়ে ওঠে অসাধু চক্র। কোনো ধরনের ফর্মুলা ও কেমিস্ট ছাড়া অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে অদক্ষ মানুষের হাতে তৈরি হচ্ছে এসব স্যালাইন। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে ভেজাল খাবার স্যালাইন উৎপাদনকারী চক্রের তিন সদস্য গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। চক্রটি ১২ বছর ধরে রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে নকল ও ভেজাল স্যালাইন। চক্রের অন্যতম সদস্য মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন ভূইয়াকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অন্য অপরাধীদের গ্রেফতারে ডিবির অভিযান শুরু হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ও ভেজাল স্যালাইন শরীরের উপকার না করে বরং ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরান ঢাকার মিটফোর্ডকেন্দ্রিক একশ্রেণির অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী খাবার স্যালাইনসহ সব ধরনের নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের একই ব্যবসা শুরু করেন। সমিতির কেউ কেউ নকল ও ভেজালকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্যালাইন ও ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নকল ও ভেজাল ঠেকাতে টাস্কফোর্স গঠনসহ এ সংক্রান্ত মামলা মনিটরিংয়ের জন্য একটি সেল গঠনের কথা বলেন সমিতির এক পরিচালক। যদিও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে নকল ও ভেজালকারীদের মামলাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। তথ্যে জানা যায়, ভেজাল খাওয়ার স্যালাইন তৈরির অভিযোগে শুক্রবার রাজধানীর মতিঝিল থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ৮০০ প্যাকেট নকল স্যালাইন জব্দ করা হয়। চক্রটি এসএমসির ওরস্যালাইন নকল করে ১২ বছর ধরে রাজধানীসহ সারা দেশের অসংখ্য দোকান ও ফার্মেসিতে বিক্রি করে আসছে। দুদিনের রিমান্ডে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ শনিবার জানিয়েছিলেন, চক্রটির কেরানীগঞ্জের নকল ওরস্যালাইন তৈরির কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ওরস্যালাইন ও কাঁচামাল জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই নকল না আসল। মিটফোর্ড থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হতো। ডিবির তদন্ত সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার ব্যক্তিদের নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তারা কোন কোন ফার্মেসিতে স্যালাইন সরবরাহ করত, শহর ও মফস্সলে কী পরিমাণ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আরও কারা জড়িত-এসব বিষয় জানার চেষ্টা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন ড. ফিরোজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, শরীরের তরল পদার্থ সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের লবণের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মানুষ স্যালাইন খায়। কিন্তু নকল স্যালাইনগুলো খেলে সেই ভারসাম্য থাকবে না। অর্থাৎ ভেজাল স্যালাইন খেলে রোগীর কাজ করছে কি করছে না, সেটি তারা বুঝতে পারবে না।
তিনি বলেন, বাজারে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ওষুধ ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের। এ ধরনের ভেজাল করা গুরুতর অন্যায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রক্তস্বল্পতা, ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়াসহ নানা কারণে স্যালাইন খাওয়া হয়। এক্ষেত্রে ভেজাল স্যালাইন খেলে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে এবং শরীরের জন্য ক্ষতি হবে। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ভেজালের মাত্রা কেমন, তার ওপর শরীরের ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সদ্য সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি যুগান্তরকে জানান, স্যালাইনসহ সব ওষুধ নকলকারী চক্রকে ভোটের রাজনীতির কারণে অনেকে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা গ্রেফতার হলেও বড় আইনজীবী নিয়োগ করে কিংবা তদবির করে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও নকল ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন, নকলবিরোধী টাস্কফোর্স গঠনসহ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নকলসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার জন্য একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি সেল গঠন কলে মামলাগুলো নিয়মিত মনিটরিং করলে নকল ও ভেজাল কমে আসবে।
২৮ মার্চ পাবনা সদর উপজেলায় নকল স্যালাইন তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে এক কারখানা মালিককে এক লাখ টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও র্যাব। কোনো কেমিস্ট ছাড়াই নোংরা পরিবেশে কিছু শ্রমিক স্যালাইন তৈরির কাজ করছিল। এ বছর রোজায় সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে নকল স্যালাইন খেয়ে ৩ বছরের শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় কারখানার মালিকসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ।
কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ নকল স্যালাইন তৈরির প্যাকেট ও বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট চকবাজারে নকল ও ভেজাল চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা খুপরি ঘরে নকল ওরস্যালাইন তৈরি করছিল। একই বছরের ১৯ জুন মাদারীপুরের শিবচর থেকে ২ হাজার ২৪ কার্টন ভেজাল খাবার স্যালাইন উদ্ধার করা হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) সালাহউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত নকল ও ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে জড়িতদের গ্রেফতারসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে এ অভিযান আরও জোরদার করা হবে।