সাক্ষাৎকার: রাজউক চেয়ারম্যান
ভবনের অনিয়মকে মালিকরা বড় অপরাধ মনে করেন না
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বহুতল ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর ভবনগুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আনিছুর রহমান মিঞা সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মতিন আব্দুল্লাহ
যুগান্তর : বেইলি রোডের অগ্নিদুর্ঘটনার পর আপনি রাজধানীর অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন; কাজের অগ্রগতি কতদূর?
রাজউক চেয়ারম্যান : প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীতে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। তবে রাজউক থেকে আমরা চেষ্টা করছি-আমাদের কারো দায়িত্বে অবহেলায় যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। এটা রাজউক নতুন করে করছে, বিষয়টি এমন নয়। এটা চলমান কাজ। অনেকাংশে অগ্রগতি হয়েছে। আরও গোছালোভাবে করার চেষ্টা করছি আমরা। পুরোপুরি কাজ শেষ করার পর অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করা হবে।
যুগান্তর : আপনি বলতে চাইছেন, রাজউক বছরজুড়ে অগ্নিঝুঁকি নিরসনে অভিযান পরিচালনা করে থাকে?
রাজউক চেয়ারম্যান : হ্যাঁ।
রাজউক বছরজুড়েই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা ভবনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। বেইলি রোডের অগ্নিদুর্ঘটনার পর অনেক লেখালেখি ও টকশোতে বলা হচ্ছে-দুর্ঘটনার পর আমরা অভিযানে নেমেছি। আগে চুপচাপ ছিলাম। কাজ করিনি; সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। বিষয়টি মোটেও সঠিক নয়। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার ছয় মাস আগে থেকে রাজউকের নেতৃত্বে, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পানি, বিদ্যুৎ, ডিসি অফিস ও গ্যাস সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্মিলিত এ অভিযানে বহু ভবনকে সতর্ক করা হয়েছে।
এসব অভিযানে দেখা হয়েছে-তাদের সিঁড়িগুলো ঠিকমতো আছে কিনা, না বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বড় ভবন, মার্কেট ও করপোরেট অফিসে যাওয়া হয়েছে। এসব সমন্বিতভাবে করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শুধু তো অভিযান করেন না, অফিসের অন্যসব কাজও তাদের থাকে। এজন্য প্রতিদিন তারা অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না। সপ্তাহে একদিন বা ১৫ দিনে একদিন অভিযান পরিচালনা করেন। পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। এসব বিষয়ে নগরবাসীকে সচেতন করতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বিশাল সংখ্যক মানুষ নিয়ম লঙ্ঘন করে, এতে তো তাদের হয়তো টনক নড়ে না। ভবনের ব্যবহার ব্যত্যয় যে বড় অপরাধ সেটা ভবন মালিকরা অপরাধই মনে করেন না।
যুগান্তর : ভবনের অনিয়ম প্রতিরোধে আপনাদের ভাবনা কী?
রাজউক চেয়ারম্যান : আপাতত ঝুঁকিপূর্ণ ও অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হচ্ছে। এসব ভবন ও প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ করা হবে। নানাভাবে সতর্ক করা হবে। এর পরও না শুনলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আপাতত কঠোর অবস্থানে যাব না। সবাইকে সুযোগ দেওয়া হবে। হঠাৎ অভিযান ও উচ্ছেদে সীমাহীন ক্ষতি হয়; আমরা নগরবাসীর ক্ষতি চাই না। তবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা রেস্তোরাঁকে কোনো সময় দেওয়া হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এটা বন্ধ হবে না। সেবা সংস্থাগুলোর যৌথ পরিদর্শন আরও বাড়ানো হবে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। আগে আমাদের সঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসন বা ডিসির প্রতিনিধি ছিলেন না। এখন তারাও আমাদের সঙ্গে থাকবেন। ডিসির প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের কাজ আরও সহজ হবে। সমন্বয়টা আরও নিবিড় করার চেষ্টা করছি।
যুগান্তর : ভবন ব্যবহারের অনিয়ম বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার প্রতিরোধে রাজউক নতুন কোনো কৌশল গ্রহণ করেছে কী?
রাজউক চেয়ারম্যান : হ্যাঁ। আমরা ভিন্নভাবে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করছি। তা হলো-রাজউক থেকে আমরা সেবা সংস্থা অর্থাৎ পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংস্থার সঙ্গে কথা বলছি যে-তারা যেন ওইসব ভবনের সেবা সংযোগ বন্ধ করে দেয় বা নতুন করে না দেয়। তাহলে অভিযান পরিচলনা ছাড়াই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রেও আমরা প্রথমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব না। প্রথমে সবাইকে সতর্ক করা হবে। টিভি টকশো ও গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত আলোচনার পরামর্শগুলো আমরা আমলে নিয়ে মানুষের ক্ষতি না করে নিয়ম বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। উচ্ছেদ অভিযান কম করে সেবা সংযোগ বন্ধ করে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।
যুগান্তর : অবৈধ ভবন নিয়ন্ত্রণে রাজউক কী ভাবছে?
রাজউক চেয়ারম্যান : এখনকার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য এখন থেকে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অবৈধ সম্প্রসারণ বা নিয়ম লঙ্ঘনের হার কমে আসবে বলে আমরা মনে করছি। একটি ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় স্থপতি, প্রকৌশলী ও রাজউকের লোকজন সম্পৃক্ত। কোনো ভবনে অনিয়ম হলে সবাইকে দায়বদ্ধ করা হবে। এছাড়া প্রতিটি ভবন মালিককে ভবনের কাজ দেখভালের জন্য একজন কারিগরি লোক নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভবন মালিক রাজউকের অনুমোদন ছাড়া তাকে বাদ দিতে পারবেন না। ওই কারিগরি লোক ভবন নির্মাণকাজ যথাযথভাবে হয়েছে কিনা তা দেখভাল করবেন। তবে যেগুলো আগে পুরোপুরি অবৈধভাব করা হয়েছে তা ভেঙে ফেলা হবে। যারা স্ট্রাকচারাল ও আর্কিটেকচার নকশা অনুমোদন করে ভবন নির্মাণ করেছেন তাদের বিষয় কী করা যায়-সে বিষয়টি নিয়ে নগর উন্নয়ন কমিটিতে আলোচনা করা হয়েছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
যুগান্তর : ভবন পরিদর্শনে থার্ড পার্টি নিয়োগের চিন্তা করছে রাজউক?
রাজউক চেয়ারম্যান: হ্যাঁ। এটা সঠিক বলেছেন। রাজউক এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা নগর উন্নয়ন কমিটিতে প্রস্তাব করেছে। সেটা বিবেচনাধীন। কমিটি অনুমোদন করলে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ভবন পরিদর্শন কাজ শুরু হবে। ঢাকায় বিপুলসংখ্যক ভবন থাকায় রাজউকের বিদ্যমান জনবল দিয়ে সব মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। জনবল দ্বিগুণ করলেও তা সম্ভব হবে না। এজন্য থার্ড পার্টির বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছে। এটা মূলত ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি পুরাতন ভবনগুলো থার্ড পার্টি দিয়ে যাচাই করা হবে। এখানে কারিগরি লোকবল নিয়োগ করা হবে। কারিগরি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে থার্ড পার্টি দিয়ে কাজ করানো হবে।
যুগান্তর : কতদিনে ঢাকার ভবন নিরাপদ করা সম্ভব হবে?
রাজউক চেয়ারম্যান : আমার বিশ্বাস আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের ভবনগুলো নিরাপদ করা সম্ভব হবে। এজন্য দুই ধরনের কাজ করতে হবে। প্রথমত এখন থেকে রাজউক এলাকায় আর কোনো ঝুঁকিপূর্ণ, অবৈধ, দুর্বল কাঠামোর ভবন তৈরি হতে দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি ভবনের ব্যবহার ব্যত্যয়ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে থার্ড পার্টি নিয়োগ করে পুরাতন ভবনগুলো সংস্কার বা ভেঙে ফেলা হবে। এ দুটি প্রক্রিয়া বিরতিহীনভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার ভবনগুলো নিরাপদ হয়ে উঠবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
যুগান্তর : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজউক কী কী কাজ করছে?
রাজউক চেয়ারম্যান : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বেশ কিছু কাজ করেছে রাজউক। প্রথমত কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখি ১০ বছর ধরে কোনো পদোন্নতি হয়নি। যাদের কোনো ত্রুটি ছিল না তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গ্রেডেশন লিস্ট করে পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া শূন্যপদের বিপরীতে ২৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। বাকিরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। নতুন করে ৯০টি পদের নিয়োগ পরীক্ষা চলছে। আরও ১১৮টি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ৫০ জনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড়ছি না। বদলি বাণিজ্য বলে কিছু নেই। বড় বদলি লটারির মাধ্যমে করা হয়েছে। কমসংখ্যক পদে যোগ্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
যুগান্তর : রাজউকের জনবলের স্বল্পতা তো দূর হয়েছে?
রাজউক চেয়ারম্যান : চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে রাজউকের জনবল পর্যাপ্ত হয়ে যাবে। অনেকে বলেন, রাজউকের জনবলের অভাবে রাজউক কাজ করতে পারে না। এসব কথা এখন রাজউকের আর বলার সুযোগ নেই। তবে বাস্তবতা হলো-চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ধরে পুলিশ। তবে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারির সংখ্যা তো বেশি নয়। থানা এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে অর্ধেক চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী হলে পুলিশও হিমশিম খেত।
ওই থানার পুলিশ বলত জনবল বাড়াতে হবে। এখনো নগরবাসী অবৈধ ভবন বানানো, ভবনের ব্যবহারে ব্যত্যয় ঘটানকে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীর মতো অপরাধ মনে করে না। একটি লোক হয়তো সারাজীবন কোনো অপরাধ করেনি, তবুও তিনি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মানছে না। ভবনের ব্যবহার ও নির্মাণের দুই ধরনের ব্যত্যয় করছে। এজন্য আমরা দুই ধরনের সচেতনতা করছি। একটি হলো-বিভিন্নভাবে নগরবাসীকে সচেতন করব এবং অপরটি তাদের চাপে রাখব। সময়মতো কাজ না করলে তাদেরটা ভেঙে দেব। পর্যায়ক্রমে এটার সমাধান করা হবে। পরবর্তীতে ব্যত্যয়কারীদের তালিকা প্রকাশ করারও চিন্তা রয়েছে রাজউকের। বড় বড় ভবনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে প্রকৌশলী ও স্থপতিদের এগিয়ে আসতে হবে।