মোহাম্মদপুরের ১২ স্পটে পাঁচ অপরাধে দুই কিশোর গ্যাং
মাস্টারমাইন্ড জুলফিকার কিশোরদের ‘দাদাভাই’
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মোহাম্মদপুর এলাকার আতঙ্ক কিশোরগ্যাং ‘ডায়মন্ড’ ও ‘ধাক্কা দে’ পার্টি। এই দুই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার অন্তত ১২টি স্পটে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ পাঁচ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে আসছে। এদের ভয়ে তটস্থ এলাকার মানুষ।
এই দুই গ্যাংয়ে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছে। তাদের অনেকেই দৃশ্যমান পেশার আড়ালে কিশোর গ্যাংকালচারে সক্রিয়। গ্যাংয়ের সদস্যরা দিনে কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ চা বিক্রেতা কিংবা প্রাইভেটকার চালক।
তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ওরা ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ। দুই কিশোর গ্যাংয়ের মাস্টারমাইন্ড জুলফিকার আলী। সে ও তার সহযোগীরা মোহাম্মদপুর এলাকায় অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। কিশোরদের কাছে জুলফিকার দাদাভাই নামে পরিচিত।
গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর, তুরাগ হাউজিং, আক্কাস নগর, ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, বসিলা হাক্কার পাড় এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাং সদস্যরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
এরা কখনো কখনো নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে পথচারীদের মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আটকে দিত ঠিকাদারের কাজ। এদের অপকর্মে রীতিমতো অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। এরা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না ভুক্তভোগীরা। এ অবস্থায় এই দুই কিশোর গ্যাংয়ের ওপর ছায়া নজরদারি শুরু করে র্যাব।
শুক্রবার মোহাম্মদপুরের হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে এই দুই কিশোর গ্যাং চক্রের মাস্টারমাইন্ড জুলফিকারসহ (৩৭) পাঁচজনকে দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩। র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতাররা কেউই কিশোর নন, তারা কিশোরগ্যাংয়ের দাদা। গ্যাংয়ের কিশোররা তাদের দাদা সম্বোধন করেন। জুলফিকার ছাড়াও গ্রেফতার অন্যরা হলেন হারুন অর রশিদ (৩৮), মো. শামছুদ্দিন বেপারী (৪৮), কৃষ্ণ চন্দ দাস (২৮) ও মো. সুরুজ মিয়া (৩৯)।
অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুটি চাপাতি ও সাতটি ছুরি উদ্ধার করা হয়। র্যাব-৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, মোহাম্মদপুরজুড়ে জুলফিকার ও তার সহযোগীদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে ডায়মন্ড ও দে ধাক্কা নামের দুটি কিশোর গ্যাং।
গ্যাং দুটির সদস্যরা নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিত। তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ করে বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত। জুলফিকারের কিশোর গ্যাং চালানোর জন্য হারুন, শামছুদ্দিন বেপারী, কৃষ্ণ চন্দ এবং সুরুজ মিয়া সহযোগী হিসেবে কাজ করত।
জুলফিকার মূলত ডায়মন্ড ও ধাক্কা দে গ্রুপের সদস্যদের দেশি-বিদেশি অস্ত্র সরবরাহ করত।
গ্যাং চক্রের সদস্যরা এলাকায় নিয়মিত মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ছিনতাই, মাদক, ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করত। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঠিকাদারের কাজ আটকে দিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুর এলাকার একাধিক ভুক্তভোগী যুগান্তরকে জানিয়েছেন, জুলফিকারদের গ্যাংয়ে এলাকার উঠতি বয়সি কিশোর-তরুণদের টানা হতো। এসব কিশোর তরুণ তার নির্দেশনা অনুযায়ী চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম করে আসছিল।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, দুই গ্যাংয়ের মাস্টারমাইন্ড জুলফিকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। এরপর একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতে শুরু করে সে। কিছু দিন ওয়ার্কশপে কাজ করার পর নারায়ণগঞ্জে পিকআপে হেলপারের কাজ শুরু করে। এ অবস্থায় মালামাল চুরির দায়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় মামলা হয়।
এরপর পালিয়ে সৌদি চলে যায়। ২০২১ সালে দেশে আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে দুই মাস জেল খেটে জামিনে বের হয়। জেলে বসে হারুনের সঙ্গে জুলফিকারের সখ্য গড়ে ওঠে। জুলফিকার জামিনে মুক্ত হয়ে হারুনকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে টিউবওয়েলের মিস্ত্রি হিসাবে কাজ শুরু করে।
এ সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদক সেবনের আড্ডার মাধ্যমে কৃষ্ণ, শামছুদ্দিন ও সুরুজসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ২০২২ সালে জুলফিকার ডায়মন্ড নামের কিশোর গ্যাং তৈরি করে। এই গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য দিকনির্দেশনা ও অস্ত্র সরবরাহ দিতে শুরু করে।
পরে আরও একটি কিশোর গ্যাং তৈরি করে যার নাম দেয় ‘দে ধাক্কা’। হারুন ২০২১ সালে আদাবর থানার একটি চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতার হয়। পরে জামিনে এসে জুলফিকারের সঙ্গে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করতে শুরু করে।
জানা গেছে, গ্রেফতার শামছুদ্দিন বেপারী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি, কৃষ্ণ চন্দ পেশায় চা বিক্রেতা এবং সুরুজ মিয়া একজন প্রাইভেটকার চালক। তারা সবাই মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এলাকায় বসবাস করে।