ফিরে দেখা ২০২৩
বছরজুড়েই খাদ্য মূল্যস্ফীতির থাবা
ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল ছিল সাধারণ মানুষ
হামিদ-উজ-জামান ও ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিদায়ি বছরে (২০২৩) নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যে নাকাল ছিল সাধারণ ভোক্তা। বছরজুড়েই ছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতির থাবা। বাজারে হঠাৎ হঠাৎ একেক নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে। চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, চিনি, লবণ, মাছ-মাংস, সবজিসহ সব ধরনের পণ্য কিনতে ক্রেতার বাড়তি টাকা খরচ হয়। পাশাপাশি পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজিতে প্রতারিত হয় ভোক্তা। এসব পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে মূল্য নির্ধারণ ও একাধিক সংস্থা মাঠে নামলেও তা ব্যর্থ হয়। ফলে বাধ্য হয়ে এ তিন পণ্য আমদানি করা হয়েছে। তবু সুফল মেলেনি। ক্রেতার কিনতে হয়েছে বাড়তি দরেই। এজন্য বছরের বেশির ভাগ সময় সাধারণ ক্রেতাদের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। এর মধ্যে বেশি কষ্টে ছিলেন মধ্যবিত্ত ও নিু আয়ের মানুষ। এছাড়া নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডারসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যের দামও এখন স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সঙ্গে ধাপে ধাপে বাড়ে ডলারের দাম। সেই ধাক্কা লাগে দেশের বাজারেও। বাড়ে মূল্যস্ফীতি। ফলে লজ্জা বাদ দিয়ে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন মধ্যবিত্ত অনেক মানুষও। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং যথাযথ তদারকির অভাবে বাজারে পণ্যমূল্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশি। যে কারণে ক্রেতাদের চড়া মূল্যে পণ্য কিনতে হলেও উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য পাননি। এ কারণে শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। পাশাপাশি সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া কোনো পদক্ষেপই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ছিল না।
প্রতিবেদনটি তৈরি পর্যন্ত রোববার (২৪ ডিসেম্বর) সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি বলছে, গত বছর একই সময়ের তুলনায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ক্রেতা সাধারণের ৩০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। সঙ্গে কেজিপ্রতি দেশি মুরগির দাম বেশি ছিল ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ৩৫ টাকা, বড় দানার মসুর ডাল ৫ টাকা, পেঁয়াজ ৭৫-১০০ টাকা, রসুন ৯০-১৪০ টাকা, হলুদ ৮০-১০০ টাকা, আদা ৯০-১৫০ টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে ফার্মের ডিম প্রতি হালি (৪ পিস) ৭ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বছরের শুরু থেকেই একটি মহল পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে নাজেহাল করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত এ বছরও ছিল। সঙ্গে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পর আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূলত এসব ক্ষেত্রে সরকারসংশ্লিষ্টদের তদারকিতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সবজি কৃষক কম দামে বিক্রি করলেও ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি নতুন বছরে অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। তাই নতুন বছরের শুরু থেকে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বছরজুড়েই ঊর্ধ্বমুখী ছিল মূল্যস্ফীতির হার। এ সময় ওঠানামা থাকলেও তা বাড়তিই ছিল। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির থাবায় জনজীবনে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। জানুয়ারিতে সার্বিকভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে। এছাড়া মার্চে এ হার আরও বেড়ে হয়েছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে এপ্রিলে তুলনামূলক বৃদ্ধির হার কিছু কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে। কিন্তু মে মাসে আবার ঊর্ধ্বমুখী হয় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। জুন ও জুলাইয়ে এ হার হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৩ এবং ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এছাড়া আগস্টে এসে খাদ্যমূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করে। এ সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এ হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে। তবে নভেম্বরে এসে কিছুটা নিুমুখী প্রবণতায় ফেরে। এরপরও দুই অঙ্ক অর্থাৎ ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পুরো বছরকে দুভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে, প্রথম ৬ মাসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এ সময়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে টাকা ছাপিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ফলে মূল্যস্ফীতি তো কমেইনি, উল্টো উসকে দিয়েছে। বছরের পরের ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টাকা ছাপানোর পথে আর হাঁটেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে সুদের হারের ক্যাপ থাকায় সুদ হার বাড়ানো যায়নি। পরে আইএমএফ-এর কর্মসূচির আওতায় সুদের হারের ক্যাপ কিছুটা তুলে দেওয়ায় সুদ হার বেড়ে যায়। এসব কার্যক্রম মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে খুব বেশি ভূমিকা না রাখলেও বাড়াতে দেয়নি।
তিনি বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে শুধু যে ডলারের দাম বৃদ্ধি বা আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বেশি হওয়াই দায়ী সেটি নয়। কেননা বছরজুড়েই দেখা গেছে একেকটা পণ্যের বাজারের একেক সময় ব্যাপক দাম বেড়ে যায়। সর্বোচ্চ বৃদ্ধির পরে কিছু দাম কমে গেলেও সেটি আর আগের দামে ফিরে আসেনি। এক্ষেত্রে বাজারের অব্যবস্থাপনা এবং কারসাজিই দায়ী ছিল।
সংকট না থাকলেও বেড়েছে চালের দাম : বিদায়ি বছরে বাজারে চালের কোনো সংকট না থাকলেও মিল মালিকরা একাধিক সময় দাম বাড়িয়েছেন। সর্বশেষ অক্টোবরে মোটা, মাঝারি ও সরু চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০-২০০ টাকা বাড়ানো হয়। ফলে পাইকারি বাজারে হু হু করে দাম বাড়ে। আর খুচরা পর্যায়ে প্রভাব পড়ায় ক্রেতার পকেট কাটা যায়। দিন আনে দিন খায় এমন খেটে খাওয়া মানুষের এক কেজি মোটা চাল কিনতে ৫৬-৫৭ পর্যন্ত টাকা খরচ করতে হয়। আর মাঝারি সরু চাল কিনতে কেজিপ্রতি ক্রেতার গুনতে হয় ৬৫-৮০ টাকা।
ডালের দামে দিশেহারা মানুষ : আমদানিনির্ভর পণ্য ডালের বাজারও বছরজুড়েই উত্তপ্ত ছিল। বছরের শুরু থেকেই কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়ে। বছরের শেষ পর্যন্ত বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডাল মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা।
চিনির দামে সর্বকালের রেকর্ড : বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। বছরের শুরুতে এক কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা। যা বছর শেষে বিক্রি হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকা।
আটার বাজারও অসহনীয় : বছরের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে আটা-ময়দার দাম। ২০২২ সালে প্রতি কেজি খোলা আটা ৩৪-৩৬ টাকায় বিক্রি হলেও ২০২৩ সালে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৪০ থেকে ৪৫ টাকা প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটা ৫৫-৬০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। প্যাকেটজাত ময়দার দাম ছিল ৫৫ টাকা। দাম বেড়ে এখন ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পেঁয়াজ নিয়েও ছিল লঙ্কাকাণ্ড : সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধি করায় দেশে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। সে সময় খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা বিক্রি হয়। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে বিক্রি না করায় ক্রেতার বাড়তি দরে কিনতে হয়। পাশাপাশি ডিসেম্বরে ভারত রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণায় সেই অসাধু বিক্রেতারা বাড়াতে থাকে দাম। দুদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মাঠ থেকে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসায় কমতে থাকে দাম। তারপরও বিক্রি হয় বাড়তি দরে। বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরা বাজারে ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
হিমাগার মালিকদের কারসাজিতে বাড়ে আলুর দাম : পর্যাপ্ত মজুতের পরও দেশে হিমাগার মালিকদের কারসাজিতে বাড়ে আলুর দাম। জুন থেকে অস্থির আলুর বাজার। সে সময় প্রতি কেজি আলু খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। পরে তদারকি জোরদার করলে ৩৫ টাকায় নেমে আসে। তবে তদারকি শিথিল করা হলে আগস্ট শেষে ফের বাড়তে থাকে দাম। আগস্টের শুরুতে কেজি ৪০ টাকা বিক্রি হলেও শেষে ৫০ টাকা বিক্রি হয়। সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় বিক্রি হলে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি খুচরা মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তারপরও দাম না কমলে অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট না ভাঙতে পেরে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। আমদানি করা আলু দেশে এলেও দাম কমে না। নতুন আলু বাজারে এলেও এখনো বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা।
ডিমের বাজারও ছিল অস্থির : জুলাইয়ে দাম স্থিতিশীল থাকলেও আগস্টে ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তখন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। আর পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৭০ টাকা। যা ১২০-১৩০ টাকা ছিল। তবে সেসময় ডিমের দাম সর্বকালের রেকর্ড ছাড়ালেও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে তদারকি সংস্থা। ফলে আগে এক পিস ডিম ক্রেতা সাধারণ ১২ টাকায় কিনতে পারলেও ১৪-১৫ টাকা খরচ হয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৪ সেপ্টম্বর প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয় না। পরে ডিম আমদানি করা হলে দাম কিছুটা কমে আসে। তারপরেও বর্তমানে প্রতি পিস ডিম কিনতে ক্রেতার ১২-১৩ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।