হলফনামা বিশ্লেষণ
অবৈধ সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছেন প্রতিমন্ত্রী জাকির
আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মন্ত্রিত্ব যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন সেই চেরাগ পেয়েই হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। কুড়িগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই সংসদ-সদস্য প্রতিমন্ত্রীর পদ পেয়েই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়।
সীমান্তবর্তী রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারীতে মাদক ব্যবসা, ভূমিদস্যুতা, তদবির বাণিজ্য ও শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। রাতের আঁধারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ অবৈধ সম্পদ দখলের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা ১৪ বছর ধরে কর্মস্থলে না গিয়েও নিয়মিত তোলেন বেতনভাতা। মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় এলাকার ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তার পরিবারের সদস্যরাও। অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাহারাদার হিসাবে এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।
যুগান্তরের অনুসন্ধান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, ভুক্তভোগীদের বক্তব্য এবং স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। দলীয় হাইকমান্ডের কাছেও তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ রয়েছে।
জাকির হোসেন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যে এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না। যদিও সাহস করে দলের স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী সম্প্রতি তার অপকর্মের ফিরিস্তি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরেন। তার দুর্নীতির সর্বশেষ উদাহরণ ঘুসের টাকা ফেরত চাওয়ায় রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রতিমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ডেকে নিয়ে তিন পাওনাদারকে বেধড়ক পেটানোর ঘটনা।
স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে কুড়িগ্রামে প্রথম এবং একমাত্র মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পান জাকির হোসেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর থেকেই তার চেহারা পালটে যায়। রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী এলাকায় অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, হাটবাজার ইজারা নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, থানায় মামলা নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ-সবই হয় প্রতিমন্ত্রীর নামে। নামে-বেনামে তার ঢাকায় একাধিক বাড়ি, রংপুরে বাড়ি, কুড়িগ্রাম জেলা শহরে বহুতল বাড়ি, রৌমারীতে দুটি বাড়ি এবং রাজিবপুর উপজেলায়ও রয়েছে একটি বাড়ি। চারটি মার্কেট, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে ৫টি স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। মিল, চাতাল, খামারবাড়ি-সবই আছে তার। যার মূল্য কয়েক শ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়, পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুরের কিছু মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মাজারও চলে মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সব বরাদ্দে মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন না দিলে মেলে না সুবিধা। ভিজিডি, ভিজিএফ, সরকারের ঘর বরাদ্দ, টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ সব কর্মসূচির বখরা যায় নেতাদের পকেটে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে হলফনামায় জাকির হোসেনের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার (স্ত্রীর আয় ৯০ হাজার টাকাসহ)। নগদ অর্থসহ মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ১৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের নির্বাচনি হলফনামায় আয় দেখানো হয় ১৪ লাখ ৪২ হাজার ২৯৫ টাকা। নগদ অর্থসহ সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ৮৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৩ টাকা।
আর ২০১৮ সালে নির্বাচনি হলফনামায় আয় কমিয়ে দেখানো হয় ২ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। আর নগদ অর্থসহ সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ৫ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার ৬৩ টাকা।
স্থানীয়রা বলছেন, সরকারের চলতি মেয়াদ শেষ হতে না হতে মন্ত্রীর এবং পরিবারের নামে ও বেনামে গড়ে উঠেছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। মন্ত্রীর বাড়ি রৌমারীর মন্ডলপাড়া রূপ নিয়েছে মন্ত্রীপাড়ায়। তার আশীর্বাদপুষ্ট সিন্ডিকেটের অন্তত ১১ জনের বহুতল বাড়ি রয়েছে বলে দলের নেতারাও অভিযোগ করছেন।
ভূমি ও সম্পদ দখল: এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানান, সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ও তার আশীর্বাদপুষ্টরা অনেক ভূমি ও সম্পদ দখলের ঘটনায় জড়িয়েছেন। রৌমারী সদর ইউনিয়নের তুরা রোডে সড়ক ও জনপথের (সওজ) ৭০ শতাংশসহ ব্যক্তিমালিকানার কিছু জমি অবৈধভাবে দখল করে ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে এই দখলের কয়েক মাস পর রাতের আঁধারে সেই সাইনবোর্ড উধাও হয়ে যায়।
বর্তমানে সেখানে প্রতিমন্ত্রীর ছেলে সাফায়াত বিন জাকির নিজস্ব পাথরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
এলাকাবাসী আরও জানান, সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের নামে রৌমারীর চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঈদগাহ মাঠ নামক স্থানে প্রায় আড়াই একর জায়গা অধিগ্রহণের জন্য নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেই জায়গা দখল করে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রায় দুই কোটি টাকার জায়গা এখন মন্ত্রীর দখলে। একইভাবে তুরা রোডের গুচ্ছগ্রামে ১৫ শতাংশ, পাশে ২১ শতাংশ ও অপর এক স্থানে ৫০ শতাংশসহ প্রায় দুই একর জায়গা দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এসব জমির বর্তমান মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
সদর ইউনিয়নের জন্তিরকান্দা নামক স্থানে সরকারি এক একর জায়গা দখল করে প্রতিমন্ত্রী ‘শিরি অটোরাইস মিল’ নামে শিল্পকারখানা নির্মাণ করেন। এ জমির মূল্য ৩ কোটি টাকা। কর্তিমারী বাজারের সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন ১নং খাস খতিয়ানের ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ শতক জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে মার্কেট। রাজিবপুর উপজেলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম সংলগ্ন ২ কোটি টাকার সরকারি পুকুরের ২০ শতাংশ জমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানঘর।
এছাড়াও বন্দবেড় ইউনিয়নের কুটিরচরে এক একর, দুইখাওয়া এলাকায় ৫ একর, উপজেলার দাঁতভাঙ্গা বাজার এলাকায় ১ একর সরকারি জায়গা দখল এবং সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভরাট করে ‘আরব আলী বাবার মাজার’ নির্মাণ করেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। ইছাকুড়ি মহিলা মাদ্রাসা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোসহ জায়গা দখল করে মন্ত্রী গড়ে তোলেন ‘জাকির হোসেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’।
মাদকের পৃষ্ঠপোষকতা : স্থানীয়রা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলেও তিনি মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের তালিকায় (গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্টের ভিত্তিতে) ‘মাদকের পৃষ্ঠপোষক’ হিসাবে নাম আসে তার। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক মাইক্রোবাসে ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় ইয়াবাসহ গাড়িচালক রফিকুল ইসলামকে আটক করে র্যাব-১৪-এর একটি দল। জাকির হোসেনের সঙ্গী সেকেন্দার বাবলুও গাঁজাসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন।
প্রাথমিকের বরাদ্দে প্রতিমন্ত্রীর বখরা : ঠিকাদারদের অভিযোগ, নিজ নির্বাচনি এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার, মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ৩০ শতাংশ হারে ভাগ নেন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম নেন ২০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ভ্যাটসহ কথিত কাজের তাগিদ। শিক্ষকরাও বিদ্যালয়ের কোনো কাজ না করেই ভুয়া বিল, ভাউচার দেখিয়ে এসব বিল উত্তোলন করেন।
১৪ বছর ধরে কর্মস্থলে অনিয়মিত মন্ত্রীর স্ত্রী : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) পদে কর্মরত আছেন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা। প্রথম দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সুরাইয়া সুলতানা কর্মস্থলে না গিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে আসছেন। ভোগ করছেন সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা। ফলে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা থেকে। কর্মস্থলে হাজির না হলেও হাজিরা খাতায় নিয়মিত বেতনভাতা তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে আসছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এর কোনোটিই সত্য নয়। এলাকার কিছু লোক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছে। আমার যে সম্পদ, তা পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। নতুন নতুন ব্যবসা করে সম্পদ বেড়েছে। ভূমি দখলের অভিযোগও মিথ্যা। মাদক নির্মূলে কাজ করলেও মাদক ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে উলটো অভিযোগ করছে, যা মিথ্যা।
তিনি বলেন, এলাকায় উন্নয়নকাজ ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য দেওয়া বরাদ্দ থেকে আমার টাকা নেওয়ার অভিযোগও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আমার স্ত্রী ইউনিয়ন অফিসে যায় না বলা হচ্ছে। তিনি আসলে উপজেলা অফিসে বসেন। এলাকায় আমার কোনো ক্যাডার বাহিনী নেই। এলাকায় বহুমুখী উন্নয়নের কারণে মানুষের জীবনমান বদলেছে, এটি দুর্নীতির কারণে নয়। এলাকার একটি গ্রুপ আমার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছে। এ কারণেই আমি মনোনয়ন পাইনি।
তিনি আরও বলেন, বিপদে পড়লে ব্যাঙও লাথি দেয়। এজন্য আমি মনোনয়ন পাইনি। হয়তো এসব খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর বিরক্ত। একজন মন্ত্রী ঘুস খেয়েছে, এটা শুনলে কি আমাকে মনোনয়ন দেবে?