খুলনা-মোংলা রেললাইন
কাজ বাকি রেখেই উদ্বোধনের তোড়জোড়
আহমদ মুসা রঞ্জু, খুলনা
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাজ বাকি রেখেই উদ্বোধন করা হবে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প। আগামী ৯ নভেম্বর খুলনার জনসভায় এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাগজে কলমে ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। শেষ মুহূর্তের কাজ বাস্তবায়নে চলছে তোড়জোড়। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, উদ্বোধনের আগে শেষ না হলেও প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদে সব কাজ শেষ হবে।
প্রকল্প কর্মকতার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ এখনো প্রায় এক বছর বাকি থাকলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে আগামী মাসে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। রেলপথমন্ত্রী চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে খুলনা সফর করেন। সেসময় তিনি বলেন, ‘উদ্বোধনের আগেই সব কাজ শেষ করা হবে। পুরো লাইন ট্রায়াল দেওয়া হবে চলতি মাসের শেষ দিকে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে ঠিকমতো কাজ করা যায়নি। এ ছাড়া মাটিও ভালো নয়। সে কারণেই দেরি হয়েছে।’
এদিকে ৯৬ কিলোমিটার রেললাইনের প্রায় ৩ কিলোমিটার কাজ এখন শেষ হয়নি। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের লতা গ্রামসংলগ্ন এলাকায় এখন লাইন বসানোর কাজ চলছে। এগুলো শেষ হতে সময় লাগবে। সেতুগুলোতে রেললাইন লাগানোর কাজ এখনো বাকি। স্টেশনগুলোতে সিগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের বেশির ভাগ কাজ বাকি। এর বাইরে ফিনিশিংয়ের অনেক কাজ এখনো অসমাপ্ত।
এ বিষয় নিয়ে খুলনা মোংলা রেল প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, দু’এক জায়গায় জমিসংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে। পুরো রেললাইনের মধ্যে কালভার্ট সেতু রয়েছে। ওই সব এলাকার মাটি নরম ছিল। রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে বিলের মধ্য দিয়ে। এগুলো জলাভূমি। এজন্য কয়েক জায়গায় মাটি দেবে যাচ্ছে। এসব জায়গার মাটি শক্ত হতে সময় নেবে। তবে ট্রায়াল রানে কোনো সমস্যা হবে না।
দফায় দফায় সময় বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, নকশা নিয়ে জটিলতা ছিল। বিশেষ করে রূপসা ব্রিজের নকশাতেও পরিবর্তন আনা হয়। জমি অধিগ্রহণ জটিলতাও কাটাতে সময় লেগেছে। অনেক জায়গায় এখনো জমির সমস্যা সমাধান হয়নি। তবে অক্টোবরে ট্রায়াল রান করা হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন হবে।
খুলনার মোহাম্মদনগর স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, জিরোপয়েন্ট সংলগ্ন ঠিকরাবাদ মৌজার কৃষ্ণনগর গ্রামে মোহাম্মদনগর স্টেশনের ভবনের উত্তর পাশের দেয়ালের বড় অংশজুড়েই ফাটল ধরেছে। সেই ফাটলে বালি সিমেন্ট দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় জিরো পয়েন্ট এলাকার বাসিন্দা বশির হোসেন বলেন, ‘নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে এত দ্রুত ফাটল ধরে। এত কোটি টাকার কাজ অথচ এত ঢিলেমি কেন?’
মোংলার দিগরাজ, আড়ংঘাটা ও ফুলতলা স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, দিগরাজে সংযোগ সড়ক নির্মানকাজ শুরু হয়নি। নতুন নির্মিত আড়ংঘাটা স্টেশনে যাওয়ার সড়কে পিচ ঢালাই হয়নি। স্টেশন ভবনের দুটি জানালার কাচ ভাঙা। ফুলতলা স্টেশনে আলাদা রেললাইন করা হয়েছে। লাইনের পাতে ঢালাইয়ের সঙ্গে ট্র্যাক লাগানো হয়নি। লাইনে দেওয়ার জন্য পাশেই পাথর স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
ডুমুরিয়ায়ার লতায় লাইনের কাজ তদারকে দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হতে আরও দেরি আছে। বাকি কাজ শেষ করতে সময় লাগবে। ছোট কাজে সময় বেশি লাগে। মোংলার অংশে কাজ দ্রুত করা হচ্ছে।’
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, রূপসা নদীর ওপর ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রেলসেতুর কাজ শেষ হয়েছে। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার পথ হলেও স্টেশনগুলোর ডাবল লাইন হিসাব করে এই প্রকল্পে রেলপথ বসবে ৯১ কিলোমিটার। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৮৮ কিলোমিটার রেলপথ বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত নয়টি প্ল্যাটফর্ম রাখা হয়েছে। সবগুলোর নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া শেষ হয়েছে ১৬০টি কালভার্ট ও ৩১টি সেতু নির্মাণকাজ। তিন কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ চলমান রয়েছে। সেই সঙ্গে ফিনিশিং, সিগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলমান।
রেলের কাজ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক আরিফুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এতবড় প্রকল্প শেষ করতে সময় লাগে। যে কাজ বাকি রয়েছে তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। কাজে ত্রুটি থাকলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেরামত করে তবেই বুঝিয়ে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর খুলনা সফরে উদ্বোধন করা হবে। সেজন্য আমরা সব কাজ তদারকিও শুরু করে দিয়েছি। উদ্বোধনের আগে কয়েকবার ট্রায়াল দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক খুলনার সম্পাদক কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘উদ্বোধনের আগেই স্টেশনে ফাটল দুঃখজনক ঘটনা। অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’
উল্লেখ্য, মোংলা বন্দর থেকে রেললাইন এসে খুলনার ফুলতলা পয়েন্টে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হবে। তা ছাড়া উত্তরাঞ্চলেও ব্যবসার প্রসার ঘটবে। এতে সরকারি রাজস্ব বাড়বে। মোংলা বন্দরের গতিশীলতা বাড়বে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতেও খরচ অনেক কম হবে। সেই সঙ্গে পর্যাটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে।