Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

এপিএস শামীমের সম্পদের পাহাড়

Icon

মতিউর রহমান ভান্ডারী, সাভার

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এপিএস শামীমের সম্পদের পাহাড়

এক দশক আগে সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় একটি মেসে থেকে টিউশনি করে কোনোরকমে জীবনযাপন করতেন শামীম আহাম্মদ। তিনি ইংরেজিতে পারদর্শী ছিলেন। তাই শিক্ষক হিসাবে সাভারের মানুষের কাছে বেশ সুনাম অর্জন করেন। মানুষ তাকে ‘ইংলিশ টিচার’ হিসাবেই চিনতেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর শামীমকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। গত ১০ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। তার রয়েছে বেলা অ্যাগ্রো পার্ক, বেলা নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ ৮টি প্রতিষ্ঠান এবং ৭টি মাছ ও গরুর খামার। যার মূল্য অন্তত ২০০ কোটি টাকা। কিভাবে তিনি এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, একান্ত সচিব হিসাবে শামীম ৩৭ হাজার টাকা মাসিক ভাতা পান। হঠাৎ তিনি এত সম্পদের মালিক বনে গেলেন কী করে এটা আমারও প্রশ্ন। এখন মন্ত্রণালয় থেকে কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম-দুর্নীতি করে টাকা উপার্জনের সুযোগ নেই। কারণ ত্রাণ বরাদ্দের বিষয়ে প্রথমে সচিব স্বাক্ষর করেন পরে আমি স্বাক্ষর করি। তাই এখানে এপিএস’র কমিশন বাণিজ্য করার সুযোগ নেই।

এপিএস হিসাবে শামীমের কাজ কি জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তার কাজ হচ্ছে কোন দিন কোথায় কোন প্রোগ্রাম আছে তা আমাকে অবগত করা। অফিশিয়ালি তার কোনো কাজ নেই। তাই বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের উৎস একমাত্র শামীমই ভালো বলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে থাকলে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। শামীম ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের রানীগঞ্জ-পোড়াবাড়ি এলাকার অধ্যাপক মফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) ওকুপেশনাল থেরাপিস্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। থাকেন সাভারের থানা রোডের মুক্তির মোড় এলাকার অ্যাভিনিউ জুনায়েদ টাওয়ারের ৬ তলায়। ওই টাওয়ারে তিনি দুটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। এর আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি।

ত্রিশাল উপজেলার মঠবাড়ী, রানীগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রানীগঞ্জ চকের (মাঠের) অধিকাংশ জায়গাজুড়ে ‘বেলা অ্যাগ্রো পার্ক’। পুরো এলাকা কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে রাখা হয়েছে। প্রায় দেড়শ বিঘা আবাদি জমি ক্রয় করে ভেকু দিয়ে খনন করা হয়েছে বিশাল আকারের মৎস্য খামার। খামারের পাড়ে হরেক রকমের বিদেশি ফলের গাছ। রয়েছে গবাদি পশুর খামারও। বেলা অ্যাগ্রো পার্কের দায়িত্বে থাকা মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, ২০১৮ সাল থেকে শামীম স্যার তার নিজ গ্রাম ও পাশের এলাকায় জমি কিনতে শুরু করেন। রানীগঞ্জ চকে প্রায় দেড়শ বিঘা জমি কেনার পর ২০২১ সালে মাটি কেটে বিশাল আকারের কৃত্রিম নদী খনন করেন। সেখানে মাছের খামার গড়ে তোলা হয়। নদী খনন করতেই ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকা। খামারে ৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যের মাছ রয়েছে। এছাড়া এই অ্যাগ্রো পার্কে আরও দুটি মাছের খামার এবং একটি গরুর খামার রয়েছে। গরুর খামারে প্রায় ৩ শতাধিক দেশি ও বিদেশি জাতের গরু রয়েছে।

পোড়াবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৮টি সেমিপাকা ঘর ও একটি ৩ তলা ভবন বেলা নার্সিং ইনস্টিটিউট ও নার্সিং কলেজ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। ভবনের সামনে রয়েছে বিশাল আকারের দুটি মাছের খামার। খামারের পাশে নার্সিং কলেজের জন্য তিনটি ৬ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। এখানে জমির পরিমাণ ৯০ থেকে ১০০ বিঘা।

নার্সিং কলেজের সামনে দেখা হয় শামীমের বড় বোনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বেলা নার্সিং ইনস্টিটিউট ছাড়া আরও ৩টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এগুলোর একাধিক শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-বেলা রিহ্যাবিলিটেশন সলিউশন পয়েন্ট, জোসনার আলো ও কাতলাসেন মৎস্য খামার। এরমধ্যে বেলা রিহ্যাবিলিটেশন সলিউশন পয়েন্টের ৩টি শাখা। এগুলো রয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মাসকান্দা নতুন বাজার, ত্রিশাল উপজেলার মঠবাড়ি ও ঢাকার গুলশানে নাভানা টাওয়ারে। জোসনার আলো’র একটি শাখা ময়মনসিংহের মাসকান্দা নতুন বাজারে। এছাড়া ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাতলাসেন এলাকায় প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে একটি মৎস্য খামার ও একটি গরুর খামার রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পোড়াবাড়ি এলাকার সত্তরোর্ধ্ব ফজলুল হক বলেন, শামীম আমাদের আত্মীয়। তার বাবা মফিজ উদ্দিন শিক্ষকতা করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো রকমে জীবনযাপন করতেন। তার নগদ টাকা-পয়সা ছিল না। এখন শামীম গ্রামের বেশিরভাগ জমি কিনে নিয়েছে। এত টাকা সে কোথায় পায়, গ্রামের মানুষ এ নিয়ে নানা রকম কথা বলাবলি করে। শামীম প্রতি সপ্তাহে দামি গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই শামীম বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। তার পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্প পরিচালকদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। এছাড়া জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ বরাদ্দে কমিশন বাণিজ্য করেন। তাকে খুশি না করলে কেউ পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পান না।

সাভার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের একজন কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, শামীম স্যার বড় বড় কাজগুলোতে হস্তক্ষেপ করেন। সাভার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণে মাটি ভরাট কাজে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তার মতে, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই সাভারের মিনি স্টেডিয়াম আলোর মুখ দেখেনি।

এ বিষয়ে এপিএস শামীম আহাম্মদ মোবাইলে যুগান্তরকে বলেন, ত্রিশালে বেলা অ্যাগ্রো পার্ক, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মাছের খামার করার ফলে এলাকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে। আগে স্থানীয়দের কাঁচা রাস্তায় কাদাপানিতে চলাচল করতে হতো। আমি জমি কেনার পর এলাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট পিচ ঢালাই করেছি। তিনি বলেন, আপনি আমার এলাকায় গোপনে গেছেন, আমাকে বলে গেলে আমি আপনাকে সঙ্গে নিয়ে সবকিছু (ক্রয়কৃত জমি ও সম্পদ) ঘুরিয়ে দেখাতাম। গেল এক দশকে প্রায় ২শ কোটি টাকা আয়ের উৎস কি? জানতে চাইলে শামীম বলেন, এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে কথা হবে। মুঠোফোনে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে পরে যোগাযোগ করেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম