Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী

শিষ্যরা কষ্টে থাকলেও গুরু মা’দের রয়েছে বাড়ি, গাড়ি * লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়, রয়েছে ‘নকল’ হিজড়াও

Icon

কায়েস আহমেদ সেলিম 

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী

‘বাচ্চাকে নাচামু, তেল মাখামু, শিরণি (টাকা) দিবি। নইলে তোরা বিপদে পড়বি! বাচ্চার বড় অসুখ হইব, পানিতে পড়ব’-এমন সব ভয়ংকর অভিশাপ দিয়ে নবজাতকের পরিবারে ভীতির সৃষ্টি করে হাজার হাজার টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল হাতিয়ে নিচ্ছে হিজড়ার দল। এদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা পান না ভুক্তভোগীরা। 

খোদ রাজধানীতেই হিজড়াদের ৫০টি আস্তানার খোঁজ মিলেছে। এসব আস্তানায় গুরু মা’র অধীনে ১৫ থেকে ২০ হাজার হিজড়া রয়েছেন। এরা দৈনিক লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। চাঁদাবাজির অর্থ দিয়ে শিষ্যের পেট চালাতে কষ্ট হলেও গুরু মা’রা গড়ে তুলেছেন বাড়ি, গাড়ি। রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমনটি উঠে এসেছে। 

রাজধানীতে হিজড়া দলের গুরু মা সুন্দরী হিজড়া, শামিমা হিজড়া, পলি, পাপ্পু, কচি, শ্রাবন্তি, পিংকি, আঁখি, রাত্রি হিজড়াসহ প্রায় ৫০ জনের দল শহরব্যাপী চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছে। 

রাজধানীর বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্টের বাসিন্দা ব্যাংকার স্বামী-স্ত্রীর ঘরে সম্প্রতি একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। এর কদিন পর বাসার ইন্টারকমে ফোন আসে। হিজড়ার কণ্ঠ! চাঁদা চাইতে এসেছে। এরা সুন্দরী হিজড়া ওরফে কাজলি হিজড়া গ্রুপের সদস্য। কোনো বাসায় শিশু থাকলেই হিজড়ারা খবর পেয়ে যায়। তারপর দল বেঁধে আসে চাঁদা চাইতে। তাদের বাসায়ও ৬ জনের একটি দল আসে। বাড়ির মালিকের স্ত্রী হাঙ্গামা হওয়ার ভয়ে হিজড়াদের নিয়ে নিজে ব্যাংকার দম্পতির ফ্ল্যাটে যান। 

ডাকাডাকির পর দরজা খুলতেই হিজড়ারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে হইচই শুরু করে এবং ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এই দম্পতির সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় নিজ বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। সেখানেও হিজড়াদের আট হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু সে কথা ঢাকার হিজড়াদের বলতেই তারা খেপে যায় এবং হইচই ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে করতে জানায় বিশ হাজার টাকার এক পয়সা কম দিলেও তারা যাবে না। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা দিয়ে দফারফা করেন। 

এ রকম ঘটনা রাজধানীতে প্রতিদিনের চিত্র। কোনো বাসায় সন্তান জন্ম নিলে উল্কার বেগে হাজির হয় হিজড়ারা। বিয়ে বাড়িতেও উৎপাত করে চাঁদার জন্য। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ উচ্চারণ করে, হইচই, গালিগালাজ করে। নগরবাসী এদের কাছে অসহায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে নগরীর পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতে হিজড়া আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। 

এছাড়াও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে হিজড়ারা। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি তাদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তারা পাত্তা দেয় না। 

রাজধানীর বাড্ডা, গুলশান, বনানী, উত্তরা, পরীবাগ ফুটওভারব্রিজ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে রাতের আঁধার নামলেই এদের অনেকে পতিতাবৃত্তিতে নামে। অনেক হিজড়া ছিনতাই ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাতে পথচারীরা রেহাই পায় না তাদের হাত থেকে। কিছু কিছু ফুটওভারব্রিজে উঠলে তাদের ডাকে সাড়া না দিলে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দেয়। 

এই হিজড়াদের মধ্যে সবাই যে প্রকৃত হিজড়া তা নয়। অনেক প্রতারক পুরুষ হয়েও মুখে মেকআপ দিয়ে হিজড়া সেজে রাস্তা, বাস ও দোকান থেকে টাকা ওঠায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে ২০ হাজার এবং রাজধানীতে প্রায় ২ হাজার হিজড়া বসবাস করে। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার। 

হিজড়াদের ৫০টি গ্রুপের মধ্যে পলি, শামিমা, পাপ্পু, কচি, পিংকি, রাহেলা, স্বপ্না, কল্পনা হিজড়ার কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। রাহেলা হিজড়া থাকেন দক্ষিণখানে। সেখানে তার একটি পাঁচ তলা বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে হিজড়ারা বসবাস করে। 

তুরাগের কামারপাড়া, রাজাবাড়ী, ধউর, রানাভোলা, বাউনিয়া এলাকায় থাকে ১০টি গ্রুপ। তাদের গ্রুপ প্রধান হচ্ছেন কচি হিজড়া। সবাই তাকে গুরু মা বলে ডাকেন। কচি হিজড়ার বিরুদ্ধে তুরাগ, গাজীপুর, উত্তরা পশ্চিম, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ কয়েকটি থানায় অন্তত ১১টি মামলা রয়েছে। রেণুকা বেগম নামে একজনকে ২০১৪ সালে হত্যার চেষ্টা করেন কচি হিজড়া। কচির দুই সহযোগী মরিয়ম ও সীমার বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় অস্ত্র মামলা রয়েছে। কচির উত্তরা ও তুরাগে একাধিক বাড়ি রয়েছে।

মোহাম্মদপুর ও আদাবরে আছে ১২টি হিজড়া গ্রুপ। একটি গ্রুপের প্রধান হচ্ছেন সুইটি। আদাবরে তার নামে আছে একটি বাড়ি। ধলপুর এলাকার আবুল হিজড়ার দুটি বাড়ি আছে। গোলাপবাগ এলাকার ১৩/বি/১ নম্বর পাঁচ তলা ও ধলপুর লিচুবাগানে একটি চার তলা ভবনের মালিকও তিনি। পিংকি হিজড়ার রয়েছে একাধিক বাড়ি-গাড়ি। তিনি পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছেন। 

এদিকে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে মেরুল বাড্ডার শামিমা হিজড়া। সে গ্রাম থেকে ছেলেদের ঢাকায় এনে ডাক্তারের মাধ্যমে সার্জারি করে পুরুষাঙ্গ কেটে তাদের হিজড়া বানিয়ে চাঁদাবাজিতে নিয়োজিত করে। তার ডেরাতে রয়েছে অনেক ‘নকল হিজড়া’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, এই শামিমা আমার পুরুষাঙ্গ কাটিয়ে জীবন নষ্ট করেছে। তার মতো পশুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। 

হিজড়াদের উন্নয়নে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সৈয়দ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, হিজড়াদের এসব কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে দিলেই স্থায়ী সমাধান হবে না। তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম