নারীদের ‘ল্যাকটেটিং ভাতা’র কোটি টাকা আত্মসাৎ
‘মূল হোতা’ মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর লালমাটিয়ার কম্পিউটার অপারেটর ইলিয়াস মিয়া
একে সালমান, মোহাম্মদপুর (ঢাকা)
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ঢাকা জেলা কার্যালয় লালমাটিয়ার কম্পিউটার ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ইলিয়াস মিয়ার বিরুদ্ধে নারীদের ‘ল্যাকটেটিং ভাতা’র কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালে তিনি এখানে যোগ দেওয়ার পর ভাতাভোগীদের নাম এন্ট্রি করতে গিয়েই শুরু করেন প্রতারণা। তার এই দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একে একে বন্ধ হতে থাকে দরিদ্র কর্মজীবী গর্ভবতী ও দুগ্ধদায়ী মায়েদের জন্য সরকারের দেওয়া ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা।
ঢাকা জেলা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ইলিয়াস মিয়া এর আগে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের হেড অফিসে থাকাকালীন দুর্নীতির দায়ে তাকে বদলি করা হয়। এরপর নানা তদবির করে ঢাকা জেলা কার্যালয়ে যোগদান করেন। এখানে এসেই ল্যাকটেটিং মাদার ভাতার টাকাসহ অন্যান্য ভাতার টাকা আত্মসাৎ করা শুরু করেন। গত চার বছর ধরে এভাবে তিনি কয়েক হাজার ভাতাভোগীর টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার এই দুর্নীতির বিষয়ে ভাতাভোগী নারীরা মহিলাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, অধিদপ্তরের সচিব, মহাপরিচালক ও ঢাকা জেলা উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় দরিদ্র কর্মজীবী গর্ভবতী ও দুদ্ধদায়ী মায়েদের জন্য সরকার ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা প্রদান করে থাকে। প্রতিজন নারীকে মাসে ৮০০ টাকা করে মোট ৩৬ মাস এ ভাতা প্রদান করা হয়। ঢাকা জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় হাজারের ওপর ভাতাভোগী রয়েছেন। অগ্রণী ব্যাংক মোহাম্মদপুর শাখায় তাদের সবার অ্যাকাউন্টে প্রতি তিন মাস পরপর টাকা জমা হতো। ভাতাভোগীরা কেউ এক বছর, কেউ ছয় মাস ভাতা পাওয়ার পর হঠাৎ করে ২০২০-২১ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংকের এই শাখাটিতে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু, ঢাকা জেলার অন্যান্য এলাকার ভাতাভোগীরা নিয়মিত ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন।
হঠাৎ করে ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ভাতাভোগীদের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে সেখানে বিকাশ, রকেট এবং নগদ অ্যাকাউন্ট বসানো হয়েছে। কিন্তু এসব কারা বসিয়েছে তা জানেনই না ভাতাভোগীরা। এছাড়াও, প্রকৃত ভাতাভোগীদের জাতীয় পরিচয়পত্র পরিবর্তন করে গাজীপুর অঞ্চলের কয়েকশ মহিলার জাতীয় পরিচয়পত্র বসিয়ে তাদের ভাতাভোগী দেখিয়ে ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ভাতাভোগীর ভাতা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। চার বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকারও বেশি।
ভাতাভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, ইলিয়াস মিয়ার এ কাজের সাথে ঢাকা জেলা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে। এ জন্য তারা অভিযোগ দেওয়ার পরও বিষয়টি ঢাকা জেলা কার্যালয় কোনো সমাধান না করে উলটো ভাতাভোগীদের হয়রানি করা হচ্ছে।
গাজীপুর এলাকার নাসিমা বেগম নামের এক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। দেলোয়ার নামের এক ব্যক্তি তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। তবে এই অ্যাকাউন্টে সরকারের দেওয়া কোনো ভাতার টাকা কখনো আসেনি। তার মতো ধীরাশ্রম গ্রামের আরেক বাসিন্দা রোকসানা আক্তার বলেন, আমার এই নাম্বারে কখনো সরকারের দেওয়া কোনো টাকা আসেনি। গাজীপুর সদর উপজেলার ধীরাশ্রম এলাকার আরজুদা বেগম, লাইলি আক্তার, পারভীন আক্তারের মতো কয়েকশ নারীর ভোটার আইডি ব্যবহার করে ল্যাকটেটিং মাদার ভাতার টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার বাসিন্দা নাজিম মিয়ার স্ত্রী লিলু বেগম বলেন, একটি এনজিওর মাধ্যমে আমি ২০২০ সালে ল্যাকটেটিং মাদার ভাতাভোগী হই। প্রথম ৬ মাস ৮০০ টাকা করে পাই। এরপর আমার অ্যাকাউন্টে আর কোনো টাকা আসে না। চার মাস অপেক্ষা করার পর ঢাকা জেলা অফিসে যোগাযোগ করে কোনো লাভ হয়নি।
ভাতার টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ঢাকা জেলা কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর ইলিয়াস মিয়া বলেন, এ বিষয়ে আমি জড়িত নই। আপনি অফিসে আসেন। আমাদের স্যারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেন।
এ বিষয়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফাতেমা জহুরা বলেন, মূল ভাতাভোগীদের এনআইডি পরিবর্তন করার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে, অনেকে ভাতা না পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে আসছে। আমরা বিষয়গুলো হেড অফিসে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটর ইলিয়াস মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে হেড অফিস থেকে তদন্ত চলছে।