চাকরি দেওয়ার নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ
এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেলওয়েতে চাকরি দেওয়া যেন নিতান্তই মামুলি ব্যাপার! প্রয়োজন হয় না নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কিংবা যোগ্যতা। শুধু চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলেই অফিস সহকারী, গেটকিপার অথবা পোর্টার পদে মিলবে চাকরি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে কর্মরত এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে এমন নানা ধরনের কাল্পনিক কথা বলে মানুষের কাছ থেকে অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মো. হোসাইন নামে ওই ব্যক্তির স্ত্রী ও শ্যালকও কর্মরত রয়েছেন সরকারি এই সংস্থাটিতে। প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছেন তিনি। নিয়োগ দেওয়ার নামে অন্তত ৩০ জনকে সর্বস্বান্ত করেছেন। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা দিয়ে একের পর এক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি।
এদিকে চাকরি প্রার্থীর টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে অস্ত্রের মুখে জামানতের চেকসহ সব প্রমাণ কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে হোসাইনের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। উপায় না পেয়ে অনেকে শরণাপন্ন হয়েছেন আদালতের।
আদালত সূত্র জানায়, রেলওয়েতে ‘পোর্টার’ পদে লোক নিয়োগের কথা বলে বাদী মো. নুরু আলমের কাছ থেকে ৪ লাখ নিয়েছিলেন অভিযুক্ত মো. হোসাইন। বাদী মামলায় উল্লেখ করেন, ৭ লাখ টাকায় পোর্টার পদে নিয়োগের নিশ্চয়তা দেন হোসাইন। গত বছরের মার্চে তাকে নগদ ৪ লাখ টাকা দেন নুরু। বাকি টাকা নিয়োগপত্র হাতে পেলে পরিশোধ করার কথা ছিল। টাকার নিশ্চয়তা হিসাবে বাদীকে হোসাইনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমিন এন্টারপ্রাইজের দুটি চেক দেওয়া হয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও নিয়োগ না হওয়ায় সেই টাকা ফেরত চান ভুক্তভোগী নুরু। একপর্যায়ে ১৮ এপ্রিল নগরীর কোতোয়ালি থানার মেমন হাসপাতাল সংলগ্ন একটি গলিতে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে তাকে ডেকে নেন হোসাইন। যাওয়ার সময় চেক ও কাগজপত্রও নিয়ে যেতে বলা হয়। সেখানে যাওয়ার পর হোসাইনের বাহিনী নুরু আলম ও তার চাচাকে একটি রুমে নিয়ে জিম্মি করে রাখে। প্রায় দুই ঘণ্টা নির্যাতন চালিয়ে টাকা ফেরত পেয়েছে বলে স্বীকারোক্তি আদায় করে ভিডিও ধারণ করে। হোসাইনের দেওয়া চেকগুলোও ছিঁড়ে ফেলা হয়। পরে ১ জুন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন তিনি। আদালত বিষয়টি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাওনা থাকায় কিশোরগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হোসাইনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মামুনুর রশিদ নামে অপর এক ভুক্তভোগী। তিনিও চাকরির জন্য টাকা দিয়েছিলেন। পরে টাকার জামানত হিসাবে হোসাইনের কাছ থেকে পাওয়া চেক দিয়ে ১১ মে আদালতে মামলা করেন। নুর আলম ও মামুনুর রশিদ ছাড়াও একাধিক ভুক্তভোগী হোসাইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এছাড়া প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ায় ৮ মে মো. সিরাজুল ইসলাম, নুর আলম ও মো. আব্দুর রাজ্জাক সুমন নামে তিন যুবক অভিযোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বরাবর। একই সময় চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়েও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মো. হোসাইন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শিপিংয়ের কার্যালয়ে ‘ম্যাটারিয়াল চেকার’ (এমসি) হিসাবে কর্মরত। তার স্ত্রী তাহেরাজু রয়েছেন ফৌজদার স্টেশন ম্যানেজারের পোর্টার বা কুলি হিসাবে। এছাড়া শ্যালক নুরুল আলম রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তার ব্যাচ নম্বর ১০৪৩। কক্সবাজারের বাসিন্দা নুরুল আলম বর্তমানে সিজিপিওয়াইতে কর্মরত।
রেলওয়ের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সরকারদলীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে হোসাইনের। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্ত্রী তাহেরাজু কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও প্রতি মাসে বেতন তুলে নিচ্ছেন। অন্যদিকে ২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে হোসাইন নগরীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-কোতোয়ালি থানায় রিয়াজউদ্দিন বাজারের আরএস রোডের আনন্দবিতান মার্কেটের ‘আমিন এন্টারপ্রাইজ’, ডবলমুরিং থানার চৌমুহনী এলাকায় কর্ণফুলী মার্কেটের ২৫৯ নম্বর দোকান, সদরঘাট থানার ৫/৬ সদরঘাট রোডের আমিন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিসহ বিটিএল লুব্রিকেন্টস ও ঈগলু আইসক্রিমের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ডিলারশিপ। এছাড়া নগরীর আলকরণ এলাকায় চারগন্ডা জমিসহ পাঁচতলা একটি ভবন ক্রয় করেছেন রেলওয়ের এই কর্মচারী। যার বাজার মূল্য দুই কোটি টাকার বেশি। নিয়োগের নামে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে রীতিমতো আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন তিনি।
ভুক্তভোগী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অফিস সহকারী’ পদে চাকরির জন্য ৯ লাখ টাকা দাবি করেন হোসাইন। তাকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম।
তবে অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে মো. হোসাইন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আদালতে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো তদন্তাধীন। এ বিষয়ে আমার আর কিছুই বলার নেই।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, হোসাইন নামে এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে রেলওয়েতে চাকরি দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। দুই সদস্যের কমিটি অভিযোগ তদন্তে কাজ করছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।