সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে শোকজ
চীনের কীটনাশক চালানো হয় সিঙ্গাপুরের নামে
হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মশার লার্ভা নিধনে নতুন কীটনাশক-বিটিআই আমদানি নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি করেছে সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জন্য মশা মারতে আনা বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) আসল নয়। প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনকারী হিসাবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকলেও তা আনা হয় চীনা কোম্পানি শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল থেকে। এতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরও কোনো হদিস নেই। নেই কোনো ব্র্যান্ড এবং পিএইচপি নম্বর। ব্যবহারবিধি কিংবা প্রয়োগের মাত্রাও উল্লেখ নেই।
এমনকি মেয়াদ ফুরানোর কোনো তারিখও নেই। অথচ প্যাকেটের গায়ে কিউলেক্স মশার ছবি দিয়ে ডিএনসিসি থেকে প্রচারণা চালানো হয়। এটি ছিল এডিস নিধনের প্রচারণা। এসব কীটনাশক ছিটানোর পর এডিশ মশার লার্ভা ধ্বংস হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় দুই দফায় কার্যক্রম উদ্বোধন করলেও বিটিআই’র কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এদিকে কীটনাশক বিটিআই জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখছে।
মশা নিধনে কীটনাশকটি সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আমদানি করা জৈব কীটনাশক বিটিআই’র প্রস্তুতকারক সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের বলে দাবি করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি। যদিও কীটনাশক প্রস্তুত ও সরবরাহের বিষয়ে সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানিই নিজেদের ফেসবুক পেজে একটি সতর্কবার্তা জানিয়ে দেয়।
এদিকে বিটিআই আমদানির ঘটনায় জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর গত সোমবার ডিএনসিসি থেকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শনোর চিঠি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এতে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড থেকে তারা বিটিআই আমদানি করছে কি না এ সংক্রান্ত সব প্রমাণ দেখাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়।
জানা গেছে, চিঠিতে কড়া ভাষায় ওই প্রতিষ্ঠানকে তথ্য প্রমাণ দিতে বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘আপনার সরবরাহকৃত বিটিআই বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিঙ্গাপুরের উৎপাদিত এবং তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত মর্মে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আপনার সরবরাহ করা বিটিআই সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উৎপাদিত ও সরবরাহ করা কীটনাশক নয় বলে ওই কোম্পানির ফেসবুক পেজে তাদের নয় বলে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তাই আপনার সরবরাহ করা বিটিআই বেস্ট কেমিক্যালের উৎপাদিত ও সরবরাহ করা কি না অবিলম্বে এ-সংক্রান্ত সব প্রমাণসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ এতে সই করেন ডিএনসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
জানা যায়, বিটিআই’র প্রথম চালানটিতে ৫ টন ব্যাকটেরিয়া ছিল। আমদানি করার চার দিন পর গত ৩০ জুলাই ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে চট্টগ্রাম থেকে পণ্যটি খালাস করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল। ৫৩ লাখ টাকার বেশি মূল্যের এই কীটনাশক আমদানি নিয়ে জালিয়াতির ঘটনাটিকে ‘নীরব’ ডাকাতি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি নগরবাসীর সঙ্গে প্রতারণারও শামিল।
জাতীয় ডেঙ্গু কমিটির সাবেক সদস্য ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিটিআই জালিয়াতি নিয়ে উত্তরের সিটির মেয়র সব দোষ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখন কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
এ ছাড়া প্রোডাক্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ডেলিভারি দেওয়ার সময় পিএইচপি নাম্বার, ট্রেড লাইসেন্সসহ বেশ কিছু তথ্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। প্রোডাক্ট রিসিভ করার সময় টেন্ডারের সব কাগজপত্র ঠিক আছে কি না বা রেজিস্টার্ড হলে তার মেয়াদ আছে কি না সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে হয়। কিন্তু ডিএনসিসি থেকে এসব কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি।
যদিও কীটনাশক বিটিআই এনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে জনগণকে এমন আশ্বস্ত করেছেন ডিএনসিসির মেয়র ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমাদ চৌধুরী আরও বলেন, মার্শাল অ্যাগ্রোভেট যদি মানুষ মারা যায় এমন কীটনাশক সরবরাহ করত তখন কী হতো? এই কীটনাশক বিষাক্ত কিনা বা ব্যবহারের উপযোগী কি না এসব যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হয়নি। প্ল্যান প্রোটেকশন রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো প্রোডাক্ট কীটনাশক বলে অ্যাপ্লাই করা যাবে না। ডিএনসিসির যে একজন কীটতত্ত্ববিদ আছেন তিনিও অনভিজ্ঞ। তিনি না বুঝে ডেঙ্গু নিধনে উলটাপালটা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
দুদকে ডিএনসিসির কীটনাশক জালিয়াতির অভিযোগ : মশা নিধনে আমদানি করা বিটিআই জালিয়াতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই জাালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক জানিয়েছেন, তাদের বাছাই কমিটি এ অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।