Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

নির্বাচন ঘিরে আবারও সক্রিয় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড

সারা দেশে জিসানের বিশাল ক্যাডার বাহিনী

Icon

কায়েস আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন ঘিরে আবারও সক্রিয় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যে নিজেদের জাহির করতে মহানগরের অলিগলিতে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারীদের একত্রিত করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে অরাজকতা তৈরি করার নীলনকশা কষছে। কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে। এদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। এসব তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

দীর্ঘদিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অপরাধী ভারত, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইতালি, কানাডা, লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ নানা দেশে আত্মগোপন করে আছে। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। এসব নিয়ে যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। চলছে পালটাপালটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজধানী ঢাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ তৎপর। প্রায়ই ঘটছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা।

এক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হচ্ছে-বিশেষ করে রাজধানীর চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে মিছিল-মিটিংয়ে। তাদের জন্য স্থানীয় নেতাদের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও করছে। চিহ্নিত এসব সন্ত্রাসীর গতিবিধি নজরদারি করছেন গোয়েন্দারা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবৈধ অস্ত্র আমদানিও বেড়েছে। প্রায়ই সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র জব্দ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অনেকেই প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নির্বাচনের আগে পরিকল্পনামাফিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করবে।

দুবাইয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মোস্ট ওয়ান্টেড শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ওরফে মন্টি ওরফে হাজি সাহেব সারা দেশেই তার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জাল ছড়িয়ে রেখেছেন। বিশাল বাহিনীর গডফাদার জিসান সরাসরি কোনো রাজনৈতিক পার্টিকে সমর্থন করেন না। তার অনুসারীদের দাবি, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তিনি সে সরকারেরই লোক। বিগত সময়ে রাজধানীতে সন্ত্রাসী কায়দায় যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার সিংহভাগই জিসানের কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে হয়েছে।

রাজধানীতে তার প্রধান সহযোগীদের মধ্য রয়েছে মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, বনানী এলাকার রুবেল, খালেদ, সাঈদ, শাহজাদা, মোক্তার, রবিন, ডালিম, রমজান, মান্নান ও আসিফ। নির্বাচনে সহিংসতা ঘটানোর আগেই তার সহযোগীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

সমাজ ও অপরাধ বিষয় নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার নেতা শাহ আসিফুল আবেদ স্বরূপ বলেন, যে দাগি অপরাধীরা বিদেশে বসে কলকাঠি নাড়ছে তাদের কিন্তু কোনো ভিত নেই। শূন্যের উপর বসবাস। যেদিকে পয়সা আছে সেদিকেই তারা ধাবিত হয়। আমার মতে, এসব প্রবাসী শীর্ষ সন্ত্রাসীর পরিবার-পরিজনদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। দেখবেন তখন অনেকাংশেই এ ধরনের অপরাধীরা গর্তে ঢুকে যাবে। এ বিষয়টি শীর্ষ অপরাধীদের ওপর প্রয়োগ করে দেখতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে অবশ্যই সতর্কও থাকতে হবে, কেউ যেন আবার অহেতুক হয়রানির শিকার না হন।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাজত্ব আর এখন নেই। যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যে কজন রয়েছে তাদের অবস্থান হয় বিদেশে নয়তো কারাগারে। এসব সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে মাঝেমধ্যে কিছু চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। পরে আমরা তা প্রতিহতও করছি। বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে। সন্ত্রাসীরা কোনোক্রমে দেশে এলে র‌্যাবের গোয়েন্দাজালে আটকা পড়বেই। এসব সন্ত্রাসীর তালিকা হালনাগাদও করা হচ্ছে ।

কে এই জিসান : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, জিসানের জন্ম কুমিল্লায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। রাজধানীর রামপুরা টিভি স্টেশনের পেছনে ৩৩৩ পশ্চিম রামপুরার দোতলা বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। তার মা মগবাজারের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। ১৯৯৬ সালের দিকে রামপুরায় গার্মেন্টেসের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জিসান আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে মিশে যান এবং এলাকার সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বুদ্ধি ও দক্ষতার কারণে হয়ে ওঠেন দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসী।

১৯৯৭ সালের পরে খিলগাঁও এলাকার সন্ত্রাসী আসিফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হয়ে যান। তখন চাঁদাবাজি, চুক্তিতে খুন, আধিপত্য বিস্তারসহ পুরোপুরি অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেন। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার আরেক সন্ত্রাসী গ্রুপ কালা জাহাঙ্গীর গ্রুপের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব এক সময় চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিএনপি সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। এ সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। সেই তালিকায় জিসানের নাম ছিল। ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই ডিবি পুলিশকে হত্যা করেন জিসান।

এরপর তাকে ধরতে তৎপর হয় পুলিশ। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর তার নামে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ডিবির দুই সদস্যকে হত্যার পর জিসানের তৎপরতা কিছুটা কমে যায়। কারণ তখন পুলিশ, ডিবি তাকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তাকে গ্রেফতারের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। দেশে গাঢাকা দিয়ে বেশিদিন না থেকে পালিয়ে ভারত চলে যান জিসান। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে নিজের নামও পালটে পেলেন। সেখানে তার নাম হয় আলী আকবর চৌধুরী।

এ নামে ভারতীয় পাসপোর্টও নেন। পরিচয় গোপন করে ভারতে গিয়েও থামেননি এ সন্ত্রাসী। সেখানে বসেই তার সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। আবার শুরু করেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ধরা পড়ার ভয় না থাকায় নিশ্চিন্তে আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রভাব বিস্তার করেন। তবে ভারতেও বেশিদিন অবস্থান করেননি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে অল্প সময়েই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। সেই টাকা দিয়ে দুবাইতে গিয়ে শুরু করেন রেস্তোরাঁ ও গাড়ির ব্যবসা। এসব ব্যবসা এখনও চালু আছে।

ডিবি সূত্রে জানা যায় ২০১৯ সালে দুবাইয়ে জিসানকে ইন্টারপোল গ্রেফতার করলেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। কারণ প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেতে বেশ কিছুদিন পার হয়ে যায় আর এই সুযোগে তিনি আমিরাতের একটি আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। ইতোমধ্যে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছে পুলিশের ইন্টারপোল শাখা।

ইন্টারপোলের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট বা এমএলএর মাধ্যমে জিসানকে ফিরিয়ে আনা যাবে।

গোয়েন্দারা বলছেন, জিসান বর্তমানে ভারত ও ডোমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম