ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে কাজে শম্ভুকগতি
আব্দুর রব, বড়লেখা (মৌলভীবাজার)
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের তৃতীয় দফা বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। চতুর্থ দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ভারতীয় ঋণে (এলওসি) বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের এখন পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ২৫.৭৬ শতাংশ। এখনো শুরু হয়নি মূল রেললাইনের কাজ। বারবার তাগিদ দিয়েও ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে (কালিন্দ রেল নির্মাণ) দিয়ে ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করাতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ চতুর্থ দফায় আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে এই মেয়াদেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র আরও জানায়, ব্রিটিশ-ভারত সরকারের উদ্যোগে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অংশ হিসাবে ১৮৯৬ সালে চালু হয় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সেকশনটি। এটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ ১০০ বছরের বেশি সময় চালু থাকা রেলপথটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় একপর্যায়ে ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ কারণে ২০০৩ সালের ৭ জুলাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া উপজেলার লোকজন। রেলপথটির সংস্কার করে পুনরায় ট্রেন চালুর দাবিতে বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি পালন করেন এসব এলাকার মানুষ। এ কারণে ২০১১ সালে বিদ্যমান মিটার গেজ লাইন সংস্কারে একটি প্রকল্প হাতে নেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৭ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি ব্যয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। পরে এ প্রকল্পে যুক্ত হয় ভারত। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্প অনুমোদনের ৬ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘কালিন্দ রেল নির্মাণ’-এর সঙ্গে সিঙ্গেল লাইনের ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। সে সময় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭৮ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ভারত এলওসির আওতায় ঋণ দেবে ৫৫৬ কোটি টাকা। বাকি ১২২ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
এলওসি ঋণের শর্তানুযায়ী, ভারতীয় অর্থায়নের প্রকল্পে দেশটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে কারণে কাজ পায় ‘কালিন্দ রেল নির্মাণ’। প্রতিষ্ঠানটিকে অধিগ্রহণ করেছে আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টেক্সমাকো রেল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।
ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৮ সালের আগস্টে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন। দুই বছর মেয়াদে ২০২০ সালের মে মাসে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও নানা অজুহাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেনি।এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ চতুর্থ দফা বাড়ানো হয়েছে।
রেলের নথি অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত কুলাউড়া-শাহবাজপুর প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ছিল ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত অগ্রগতি ছিল ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী, ১৮ মাসে কাজ সম্পন্নের কথা থাকলেও দুই বছরে কাগজে-কলমে কাজ এগিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি (কালিন্দ রেল নির্মাণ) আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণের কাজ পায়। তারা ওই প্রকল্পে কাজ করায় শাহবাজপুর-কুলাউড়া সেকশনে কাজ বন্ধ রেখেছে। বারবার তাগিদ দিয়েও ঠিকাদারকে দিয়ে শাহবাজপুর-কুলাউড়া সেকশনে কাজ করাতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কখনো করোনা, কখনো জমি, বিদ্যুতের খুঁটি বা গাছের অজুহাত দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এ পরিস্থিতিতে ভারতীয় ঠিকাদারকে বাদ দিতে চুক্তি বাতিল করতে চেয়েছিল রেলওয়ে। এক্ষেত্রে অর্থায়নকারী হিসাবে চুক্তি বাতিলে ভারতের সম্মতি প্রয়োজন। তবে ভারতের সম্মতি না পাওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যায়নি।
সরেজমিন দেখা যায়, গত এক বছর ধরে কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে কচ্ছপগতির কাজ হচ্ছে। হঠাৎ সপ্তাহদুয়েক কাজ হয়। এরপর মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। গত কয়েক মাস কাজ একদম বন্ধ রয়েছে। এতে নির্মাণসামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। রড ও অন্যান্য সামগ্রীতে মরিচা ধরেছে।
কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুনর্র্নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার মেইন লাইন ও ৭ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ মোট ৫১ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার রেললাইন হবে। এ সেকশনে গার্ডার ব্রিজ ১৭টি ও কালভার্ট ৪২টি পুনর্র্নির্মাণ করা হবে। থাকবে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা। একই সঙ্গে ৬টি স্টেশন ভবন ও প্ল্যাটফর্ম পুনর্র্নির্মাণ করা হবে।
জানতে চাইলে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের পরিচালক সুলতান আলী বলেন, ‘নতুন করে চতুর্থ দফায় কাজের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চলতি মাস পর্যন্ত কাজ হয়েছে ২৫.৭৬ শতাংশ। আমরা কাজটা দ্রুত আদায়ের চেষ্টা করছি। আশা করছি এই মেয়াদে কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।’
বিলম্বের কারণ হিসাবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘করোনা, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণ রয়েছে। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানটির আখাউড়া-আগরতলায় আরেকটি প্রজেক্ট চলছে। ওই প্রজেক্টে জোর দেওয়াতে ওখানে (কুলাউড়া-শাহবাজপুর) বিলম্ব হয়েছে। তবে চলমান বর্ধিত মেয়াদেই কাজ সম্পন্ন হবে’।