মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভুয়া সনদে
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মো. আবু তাহের ওরফে এলএমজি তাহের। অন্য মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করে তিনি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পদবিও বাগিয়ে নেন। এ পদবি ব্যবহার করে এলাকায় নানা অপকর্ম করেছেন। অমুক্তিযোদ্ধাদেরও মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়েছেন। বছরের পর বছর তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। নিজের দ্বিতল বাড়ি থাকলেও ভূমিহীন দাবি করে লিজ নিয়েছেন সরকারি কৃষিজমি। তবে শেষ পর্যন্ত তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তদন্তে তার অপকর্মের সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আবু তাহের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তাই তার রাষ্ট্রায়ত্ত ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ এবং অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে।
জানা যায়, কয়েক মাস আগে সাতকানিয়া উপজেলার পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গার নলুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এলএমজি তাহেরের বিরুদ্ধে উপজেলার নয়জন মুক্তিযোদ্ধা সুনির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। অভিযোগ তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়। সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগে সাতকানিয়ার সংসদ-সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এলএমজি তাহেরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল-নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ আবু তাহের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নেননি। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কেউ তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে চিনতই না। একই উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নে আবু তাহের নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তার বাবার নামও আবদুর রহমান। তার লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০২০২০৬০১৯৫ এবং ভারতীয় তালিকার নম্বর ২১৮২। ছদাহা ইউনিয়নের সেই মুক্তিযোদ্ধার লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ও তালিকা ব্যবহার করে এলএমজি তাহের সরকারি কাগজপত্রে নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়ে যান। তার নামে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) চালু হয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সাতকানিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসব অভিযোগের তদন্তে নামেন। তদন্ত শেষে তিনি প্রতিবেদন সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদন জেলা প্রশাসন হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যায়।
সাতকানিয়ার ইউএনও ফাতেমা-তুজ জোহরা স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ছদাহা ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের এবং নলুয়ার ইউনিয়নের আবু তাহের ভিন্ন দুই ব্যক্তি। ছদাহারের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরের নাম অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে নলুয়ার আবু তাহেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়। সহকারি সচিব তাপস কুমার ভৌমিক স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আবু তাহেরের (বেসামরিক গেজেট ২৯৭৭) প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তার এমআইএস বাতিল এবং তার রাষ্ট্রীয় সম্মানি ভাতা প্রত্যাহার করতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এছাড়া এ পর্যন্ত যত টাকা রাষ্ট্রীয় সম্মানি ভাতা হিসাবে তিনি গ্রহণ করেছেন, তা আদায় করে সংশ্লিষ্ট কোডে জমা দিয়ে চালানের এক কপি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অনুরোধ করা হলো।’
সাতকানিয়া উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এলএমজি তাহের মুক্তিযোদ্ধা নন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। নানা অপকর্মে জড়িত। এলডিপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাহের মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর কারিগর। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তিনি মন্ত্রণালয়ে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি করে লিখিত অভিযোগ দিতেন। সাতকানিয়ার আরেক মুক্তিযোদ্ধা হাফেজ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আবু তাহের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন-এমনটি দাবি করেননি। এরপর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বনে যাওয়া এবং এ পদবি ব্যবহার করে কৃষিজমি লিজ নেওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে শুরু করলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। শুরু থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তা নিয়ে মন্ত্রণালয় বা জেলা প্রশাসন আমলে নেয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।
আবু তাহেরের বক্তব্য : এলএমজি তাহের বলেন, সাতকানিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি দেশে ১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলাম-ইউএনও মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা আত্মসাৎ করেছেন। আর এ অভিযোগের পর তিনি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মানি ভাতা বন্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন সহকারী সচিব সম্মানি ভাতা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা বন্ধ হয়নি। আমার ভাতা চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রী। কৃষিজমি লিজ নেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে শর্তভঙ্গ করে কিছু জমি হস্তান্তরের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। এছাড়া সংসদ-সদস্যের দেওয়া ডিও লেটারও প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।