কয়লা সংকট
বন্ধ হয়ে যেতে পারে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
বিলাস দাস,পটুয়াখালী
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কয়লা সংকটে পড়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। কয়লার যে মজুত আছে তা দিয়ে আগামী ১৫ দিন এটি চালু রাখা সম্ভব হবে। এরপর বন্ধ হয়ে যেতে পারে উৎপাদন। এতে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে দেশ। চলমান এ জটিলতা কাটিয়ে না উঠলে জাতীয় অর্থনীতিতে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জানা যায়, ডলার সংকটে কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে দেশের সর্বাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
তবে কবে নাগাদ এ জটিলতা কাটিয়ে সংকট নিরসন হবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের অস্পষ্ট বক্তব্য। যদিও এ সংকট কাটিয়ে উঠে বিদ্যুৎ সেবা অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা করছেন তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ বিদ্যুতের জোগান দেয় পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। যে কারণে রমজান মাসেও দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সেবা দিতে সক্ষম হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের সবকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে এটি আধুনিক। এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে বড় সংকটে পড়বে দেশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোদমে চালাতে গড়ে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা ব্যবহার হয়। যার পুরোটাই ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি)। ডলার সংকট দেখা দেওয়ায় গত ছয় মাস ধরে কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি। ফলে ২৯৮ মিলিয়ন (২৯ কোটি ৮০ লাখ) মার্কিন ডলার বা ৩ হাজার ১৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) বকেয়া পড়েছে। সিএমসি বলছে-বকেয়া পরিশোধ না করলে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
গত ১৩ এপ্রিল বিসিপিসিএলকে দেওয়া এক চিঠিতে সিএমসি বলে, ২৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়ার কারণে ‘পিটি বায়ান রিসোর্সেস টিবিকে’ নামের ইন্দোনেশিয়াভিত্তিক কোল-মাইনিং কোম্পানির কয়লা সরবরাহে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে চায়নার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে আরও বলা হয়, এপ্রিলে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৫৩২৫ কোটি টাকা) পরিশোধ করা হলে মে মাসের জন্য এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা যাবে। আবার মে মাসে ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৭৪৫৫ কোটি টাকা) এবং পরবর্তী প্রতি মাসে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হারে পরিশোধ করা হলে প্রয়োজনীয় কয়লা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে ঋণপত্র খোলায় কোনো বাধা থাকবে না।
এছাড়া গত ২৭ এপ্রিল সিএমসি ই-মেইলের মাধ্যমে বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। ওইদিনই বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষ অনুরোধ জানান বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম। বিদ্যুৎ সচিবকে পাঠানো ওই চিঠিতে বিসিপিসিএল বলে-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দ্রুত বকেয়া পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে ব্যাপকভাবে লোডশেডিং হলে জাতীয় অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে।
বিসিপিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়লা আমদানি সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী সিএমসি কয়লা ক্রয়ের ছয় মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রোভাইড করে সিএমসি। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হলো-আমরা ইন্দোনেশিয়া থেকে যে কয়লা ক্রয় করি, তার ইনভয়েসের এগেইনস্টে সিএমসি এলসি করে পেমেন্ট করে। চুক্তি অনুযায়ী, আমাদের পেমেন্ট মেথড হলো ডেফার্ড পেমেন্ট (দেরিতে পরিশোধ)। আমরা ছয় মাস পর সিএমসিকে টাকা পরিশোধ করি। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ইন্দোনেশিয়ার কোল-মাইনিং কোম্পানিকে সিএমসি যে পেমেন্ট দেবে, আমরা জুলাইয়ে সিএমসিকে তা পরিশোধ করব। মূলত নির্ধারিত সময়ে অনেক আগেই অতিবাহিত হয়ে আরও পাঁচ মাস চলে গেছে। অথচ বকেয়া অর্থ শোধ করা হয়নি। এত টাকা বকেয়া হওয়ায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কয়লা ক্রয়ে নতুন করে এলসি খুলতে সিএমসিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পায়রার জন্য কয়লা আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে না। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করি কয়লার জোগান নিরবচ্ছিন্ন থাকবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো বাধা তৈরি হবে না।’ পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক শাহ্ আবদুল মওলা বলেন, ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চালুর পর এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি এর আগে কখনো হয়নি। মূলত টাকা পরিশোধ করে কয়লা আমদানি করতে হয়। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বকেয়া পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। এসব জটিলতা কাটাতে আমাদের যথেষ্ট উদ্যোগ রয়েছে। তাছাড়া মজুত কয়লা দিয়ে এ মাস পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব হবে। এর মধ্যে ডলার না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।