Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

আবারও সিন্ডিকেটের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবারও সিন্ডিকেটের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

বঙ্গবাজারে স্থায়ী ভবন নির্মাণের খবরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাদের কেউ কেউ মার্কেট নির্মাণ হলে দোকান বরাদ্দ পাবেন কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা করছেন। আবার কেউ আদৌ মার্কেট নির্মাণ হবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের শঙ্কা অতীতের ন্যায় মার্কেটের ওপর কর্তৃত্ববাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। যদিও নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, এর আগেও বঙ্গবাজারে স্থায়ী ভবনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় ভবন নির্মাণে হোঁচট খেয়েছে সিটি করপোরেশন। নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট এবারও সক্রিয় রয়েছে। স্থায়ী মার্কেট নির্মাণ হলে চাঁদাবাজি, দোকান বিক্রিসহ অবৈধ উপার্জন লাটে উঠবে তাদের। এ কারণেই তারা যেকোনো কৌশলে স্থায়ী ভবন নির্মাণে বাদ সাধতে পারে-এমন আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এ মাসেই মার্কেট নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ব্যবসায়ী সমিতি মঙ্গলবার ৯ সদস্যের একটি তালিকা দিয়েছেন মেয়রের কাছে। সময় নির্ধারণ করে তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ইতোপূর্বে ১০ তলা ভবনের নকশাসহ সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এদিকে ঈদের পর বঙ্গবাজারে অস্থায়ী চৌকিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে তপ্ত রোদ-গরমে খোলা আকাশের নিচে তারা বসতে পারছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার আর সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। তখন ওই জায়গার ব্যবসায়ীদের সরিয়ে বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে বসানো হয়। সেই সময় কাঠ ও টিন দিয়ে গড়া স্থাপনায় বসেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এরপর আর এই জায়গা থেকে নড়ানো যায়নি কাউকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওই দুই মার্কেটে খুব কম দোকানই পেয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। সব দোকান গেছে রাঘব বোয়ালদের পেটে।

বঙ্গবাজারের দুজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকারের অনুসারীরাই বঙ্গবাজারে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রেখেছেন। অপরিকল্পিতভাবে দোকান তৈরি করে বিক্রিসহ নানা কায়দায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের অপতৎপরতার কারণে বঙ্গবাজারের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাও আধুনিকায়ন করা যায়নি।

বঙ্গ ইউনিট, মহানগরী ইউনিট, গুলিস্তান ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট এই চারটি মার্কেট মিলেই বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স। গত ৪ এপ্রিলের ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজার পুড়ে কয়লা হয়ে গেলেও এখনো এই মার্কেট ঘিরে নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের তৎপরতা থেমে নেই।

মঙ্গলবার বঙ্গবাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মার্কেটের চারটি ইউনিটের দোকান ছিল ২৫৪৫টি। পরে বিভিন্ন সময়ে মহানগরী ইউনিটে নতুন ১১৮টি, গুলিস্তান ইউনিটে ১৬৫টি ও আদর্শ ইউনিটে ১৩৩টিসহ মোট ৪১৬টি দোকান তৈরি করে কৌশলে বিক্রি করা হয়। এ নিয়ে বর্তমানে দোকান সংখ্যা ২৯৬১। নতুন একেকটি দোকান ১০ লাখ থেকে শুরু করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

মহানগরী ইউনিটের ব্যবসায়ী মাকসুদ পাটোয়ারি যুগান্তরকে বলেন, আমার দুটি দোকান ও একটি গোডাউন মিলে ৬৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। এখন পর্যন্ত একটি টাকাও কারও কাছ থেকে সহায়তা পাইনি। এক বন্ধুর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করে কিছু মালামাল নিয়ে বসেছিলাম। রোদের কারণে এখন আর বসতে পারছি না। তিনি বলেন, আমরা চাই কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই এখানে নতুন ভবন হোক।

তবে নতুন ভবনে যাতে আমাদের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই দাবি জানাই। তাছাড়া ভবন নির্মাণকালীন আমাদের যেন বিকল্প কোনো জায়গায় অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ো হয় সেই অনুরোধ করছি। শুধু মাকসুদ পাটোয়ারিই নন, এমন দাবি জানিয়েছেন মানিক, হৃদয়. মামুন, একেন আলীসহ অন্য ব্যবসাযীরাও।

এদিকে, দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রকদের শোষণের শিকার হলেও ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে তাদের নাম মুখে আনতে ভয় পাচ্ছেন। গত ১১ এপ্রিল কামাল হোসেন রিপন নামে এক ব্যবসায়ী মার্কেট কমিটির অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মারধরের শিকারও হয়েছেন।

একাধিক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে জানান, বঙ্গবাজার মার্কেটটি শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। একসময় মার্কেটটি ছিল কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের নিয়ন্ত্রণে। এরপর বিভিন্ন হাতে ঘুরেছে মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সভাপতি শাজাহান মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক মজু হলেও মূল নিয়ন্ত্রণ অন্যদের হাতে। অভিযোগ রয়েছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাজমুল হুদা, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাবুদ্দিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন।

তারা দোকানগুলো থেকে মাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করতেন। এ ছাড়া নতুন দোকান তৈরি করে বিক্রি করা হতো চড়া দামে। তাদের মধ্যে মো. শাহাবুদ্দিন যুবলীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বহিষ্কৃত সভাপতি। সূত্র বলছে, তিনি পুরো গুলিস্তান এলাকার মার্কেটের নিয়ন্ত্রক। বঙ্গবাজারের আদর্শ ইউনিট মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক হলেও মহানগর, বঙ্গ, গুলিস্তান ইউনিটেরও নিয়ন্ত্রণ শাহাবুদ্দিনের হাতে। তার রয়েছে একটি চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুনে পোড়ার আগ পর্যন্ত শাহাবুদ্দিনের নির্দেশ ছাড়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে কোনো কাজ হতো না। দোকান বিক্রি থেকে শুরু করে ভাড়া, সব কিছুতেই শাহাবুদ্দিনের মুখের কথাই আইন। একইভাবে গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের একক আধিপত্যও এই শাহাবুদ্দিনের। ২০২০ সাল থেকে বঙ্গবাজারে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। এ নিয়ে হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটে। শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বংশাল থানা, শাহবাগ থানা ও আদালতে মামলা রয়েছে। তার নিয়ন্ত্রণে এই এলাকায় একটি চাঁদাবাজ চক্রও সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এসব বিষয়ে মঙ্গলবার মো. শাহাবুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি তো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে ডিঙিয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের কিছু করার থাকে না। আমি তো রাজনীতি করি। আমার প্রতিপক্ষ আছে। সব অভিযোগ ঠিক নয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে যারা মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ করেছেন তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ৪১৬টি নয়, সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর পর যখন সিটি করপোরেশনে তত্ত্বাবধায়ক বসানো হয়েছিল, তখন নতুন ৫৯১টি দোকান তৈরির পর অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাজমুল হুদা চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, আমরা অবৈধভাবে কোনো দোকান বিক্রি করিনি। যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করে, তারা সঠিক তথ্য দেয়নি। এবার মার্কেট নির্মাণে কোনো বাধা থাকবে না বলেও দাবি করেন জহিরুল ইসলাম।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম