Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

ঢাকা বন বিভাগে ঘাঁটি গেড়েছেন ফরেস্টাররা

Icon

মুহাম্মদ আবুল কাশেম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা বন বিভাগে ঘাঁটি গেড়েছেন ফরেস্টাররা

বদলি নীতিবহির্ভূত একের পর এক আদেশে ভেঙে পড়েছে ঢাকা বন বিভাগের অধীন গাজীপুরের মাঠ প্রশাসন। এতে জেলাজুড়ে অবাধে বনভূমি জবরদখল হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য তদবির বাণিজ্যের ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিটগুলোতে পোস্টিং টেকসই করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকজন ফরেস্টার। ঢাকা বন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ রেঞ্জগুলোর রেঞ্জ কর্মকর্তার চেয়ার বাগিয়ে নিয়েছেন ফরেস্টাররা। এতে খোদ বন বিভাগ এখন শালবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিণামে গাজীপুরের বিস্তীর্ণ বনভূমি লাগাতার জবরদখলে বিক্ষিপ্ত বনভূমি হয়েছে।

কাগজকলমে গাজীপুরে ৫২ হাজার একরের বেশি বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে এর অর্ধেক বনভূমি আছে কিনা-এমন আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। জেলায় মাঠপর্যায়ে কর্মরত ফরেস্টারদের তদবির চাপে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) একের পর এক বিধিবহির্ভূত বদলি আদেশ করে যাচ্ছেন। অনিয়মতান্ত্রিক এসব তদবির রক্ষায় বাধ্য হচ্ছেন বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও। গাজীপুরে ঢাকা বন বিভাগের অধীন কালিয়াকৈর, রাজেন্দ্রপুর, শ্রীপুর ও কচিঘাটা রেঞ্জ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন ফরেস্টার পদমর্যাদার আশরাফুল আলম ওরফে দোলন। ফরেস্টার হয়েও বিগত দুই বছর ধরে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই রেঞ্জটির দায়িত্বে তিনি। এই ফরেস্টার গাজীপুরে কর্মরত সাত বছরের বেশি সময় ধরে। গেল ১৯ মার্চ এই ফরেস্টারকে কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তার পদ থেকে বদলির আদেশ করেন (অফিস আদেশ-২৩) ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। অথচ লিখিত সেই বদলির আদেশ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। যদিও সেই আদেশ গত ২১ মার্চ প্রকাশ পায়। আশ্চর্যজনকভাবে ফরেস্টার আশরাফুল আলমকে গাজীপুর জেলা থেকে বদলি না করে জেলার একই উপজেলায় এসএফএনটিসি কর্মকর্তা পদে বদলির আদেশ হয়। এর আগে এই ফরেস্টার শ্রীপুর রেঞ্জের সিমলাপাড়া বিট ও রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের মনিপুর বিটে কর্মরত ছিলেন। মনিপুর বিটে থাকাকালীন ২০১৮ সালের ২৭ মে তাকে সিলেট বন বিভাগে বদলির আদেশ করেন তৎকালীন বন সংরক্ষক মো. রকিবুল হাসান মুকুল। তবে রহস্যজনকভাবে তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক মো. সফিউল আলম চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট এই ফরেস্টারের বদলির আদেশ বাতিল হয়। তাকে একই তারিখে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয় গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা চেক স্টেশনে। পরে চেক স্টেশন থেকে তদবির করিয়ে তিনি কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তার চেয়ার বাগিয়ে নেন। ফরেস্টার মীর বজলুর রহমান। তিনি গাজীপুর জেলার স্থানীয় অধিবাসী। অথচ স্থানীয় অধিবাসী হয়েও বিগত দিনে জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিটে অর্ধযুগের বেশি বিট কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে গাজীপুর থেকে বদলি করা হলেও কয়েক বছর আগে তিনি ফের সেই গোসিংগা বিটেই বদলি হয়ে আসেন। পরে তদবির করিয়ে শ্রীপুর সদর বিট কর্মকর্তার দায়িত্বের পাশাপাশি শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে তিনি বহালতবিয়তে শ্রীপুর সদর বিটের দায়িত্ব পালন করছেন।

ফরেস্টার ইলিয়াছ হোসেন। পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে তিনি কালিয়াকৈর রেঞ্জের বোয়ালী বিটে পোস্টিং নেন। পরে সেখানে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পর প্রাইজ পোস্টিং পান চন্দ্রা চেক স্টেশনে। বিধিবহির্ভূতভাবে চেক স্টেশনে এক বছরের অধিক সময় দায়িত্ব পালন করার পর ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম তাকে শ্রীপুর রেঞ্জের রাথুরা বিটে বদলি করেন। তবে রাথুরা বিট তার মনোপূত না হওয়ায় মাত্র কয়েক মাসের মাথায় (ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস আদেশ-৭৬, তারিখ : ১৫/১২/২০২২) তদবির করিয়ে তার পছন্দের কাচিঘাটা সদর বিটে পোস্টিং নেন।

ফরেস্টার নূর মোহাম্মদ। এই ফরেস্টার গাজীপুরে কর্মরত অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে। বিগত দিনে তিনি রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের মনিপুর বিটে কর্মরত ছিলেন। জবরদখলকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও টিনশেড বাড়ি ভাঙতে গিয়ে তিনি গণধোলাইয়ের শিকার হন। যদিও এমন অভিযোগের ঘটনায় তাকে প্রত্যাহার না করে চন্দ্রা চেক স্টেশনে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে কালিয়াকৈর রেঞ্জের রঘুনাথপুর বিটে দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে গাজীপুরে সোনার খনি হিসাবে খ্যাত চন্দ্রা বিট কর্মকর্তার দায়িত্ব বাগিয়ে নেন।

ফরেস্টার তমিজ উদ্দিন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী রমিজ উদ্দিনের সহোদর তিনি। প্রভাব খাটিয়ে গাজীপুর কালিয়াকৈর রেঞ্জের মৌচাক বিট কর্মকর্তার দায়িত্ব পান তিনি। মৌচাক বিটে তার ছয় মাসের কম কর্মকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে বনভূমি জবরদখল হয়। বনভূমি জবরদখল উদ্ধারে উপজেলা প্রশাসন ভাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করে। অথচ এই ফরেস্টারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বন বিভাগ। উলটো তাকে রক্ষা করতে গত বছরে ১৫ ডিসেম্বর (ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস আদেশ-৭৬) একই উপজেলার কাচিঘাটা রেঞ্জের খলিশাজানি বিটে বদলি করা হয়। তার ভগ্নিপতি ফরেস্টার মো. আবু ইউনুছকে একই রেঞ্জের সদর বিট থেকে একই আদেশে কালিয়াকৈর বোয়ালী বিটে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়। সাভারের বারুইপাড়া বিটের বনভূমি জবরদখলে সহযোগিতাকারী ফরেস্টার শহিদুল আলমকে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয় মৌচাক বিটে। ওই আদেশে দুর্নীতিতে পটু ফরেস্টার মো. মাসুম উদ্দিনকে বোয়ালী বিট থেকে কালিয়াকৈর রেঞ্জের রঘুনাথপুর বিটে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়। অথচ তার বিরুদ্ধে বনভূমি জববরদখলে সহযোগিতা, বনের গাছ পাচার, বনে পুকুর ও রাস্তা নির্মাণে ঘুস গ্রহণ, হাতেনাতে ধৃত আসামি ছেড়ে দেওয়াসহ বনের মাটি পাচারে ব্যবহৃত ভেকু থেকে ঘুস গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তার বিট থেকে মাটিসহ ট্রাক জব্দ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়।

গাজীপুরে সিনিয়র ফরেস্টারদের বদলি না হওয়া প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় অঞ্চল বন সংরক্ষক (সিএফ) হোসাইন মুহম্মদ নিশাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা বন বিভাগে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন আশরাফুল আলম? দ্বিতীয় অবস্থানে নূর মোহাম্মদ। সম্প্রতি মঞ্জুকে বদলি করা হয়েছে।’ গাজীপুরের স্থানীয় অধিবাসী হয়েও নিজ জেলায় চাকরি করছেন মীর বজলুর রহমান ও সামসুজ্জামান? এতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বনভূমি জবরদখলের সম্ভাবনা থাকে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি তেমন নয়। তিন বছর হলে বদলি করা হবে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম