শতকোটির মালিক কর্মচারী
সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় আঙুল ফুলে কলাগাছ ভাই মৃদুল
তোজাম্মেল আযম, মেহেরপুর
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরফরাজ হোসেন মৃদুল। ২০১২ সালেও মেহেরপুর জেলা শহরের মহিলা কলেজমোড় সংলগ্ন প্রধান সড়কে ‘ওষুধ বিপনী’ নামে এক ফার্মেসির কর্মচারী ছিলেন। দিনাতিপাত করতেন অতিকষ্টে। ফলে রেশনের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য নিতে দেখা গেছে তাকে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার ভাই সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নৌকার মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মৃদুলের ভাগ্য বদলে যায়। ২০১৫ সালে ভাগিয়ে নেন জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে বনে যান শত কোটি টাকার মালিক। জানা গেছে, ভাই এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দেবাশীষ বাগচি নামে একজনকে ব্যবসায়িক অংশীদার নিয়ে শুরু করেন ঠিকেদারি ব্যবসা। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক দিয়ে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেন দেবাশীষকে। সেই চেক ব্যাংকে ডিজঅনার হলে মৃদুলের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে দেবাশীষ। মৃদুলও দেবাশীষের নামে চেক চুরির মামলা করে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেন। বাধ্য হয়ে দেবাশীষ আত্মগোপনে চলে যান। ৫ আগস্ট দেশের পরিবর্তন হলে দেবাশীষ আত্মগোপন থেকে ফিরে আসেন। দুপক্ষের মামলা এখনো চলমান। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় ৭ জানুয়ারি মেহেরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা দিতে আসে মৃদুল। ওই মামলায় বিচারক তার জামিন নামমঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। সূত্র মতে, জেলার প্রায় প্রতিটি স্কুলের ভবন নির্মাণ কাজ করেছে মৃদুল। নির্মাণে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রীর ভাই হওয়ার কারণে কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। সরকারি বিভিন্ন অফিস, আদালত, হাসপাতাল সংস্কারকাজ, মুজিবনগর কমপ্লেক্সের রক্ষাণাবেক্ষণসহ প্রায় প্রতিটি কাজের নিয়ন্ত্রক ছিল মৃদুল। ৭ কোটি টাকা ব্যয়ের মেহেরপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ৭ তলার একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ সৈকত এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্সে এখনো চলমান মৃদুলের। এ ছাড়া তার বাবার নামে ছহিউদ্দিন টেক্সটাইল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ, জেলা পরিষদের গেস্ট হাউজ ও পুলিশ লাইনের গেস্ট হাউজ নির্মাণ তার নিয়ন্ত্রণে এখনো চলমান। এ ছাড়া বিনা টেন্ডারে মেহেরপুর খাদ্য গুদামে ঠিকাদারি কাজে করেছেন লুটপাট। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে উন্মুক্ত মাঠে টাইলসের কাজও করেছেন মৃদুল। এসব করে ১০ বছরেই আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন। কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে মৃদুল মেহেরপুর শহরের অদূরে দিঘিরপাড়াতে এক দাগে কিনেছেন ১০ বিঘা জমি, কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন শহরের ক্যাশবপাড়ায় প্রাইমারি স্কুলের পাশে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের বাড়ি, মেহেরপুরে পার্কের সামনে গড়ে তুলছেন আলিশান মার্কেট। এ ছাড়া অবৈধ আয়ে ঢাকার আদাবরে ৭নং সেক্টরে রয়েছে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, উত্তরা ৬/এ আরও একটি অ্যাপার্টমেন্ট, গুলশানে অফিস, একটি নোয়া গাড়িসহ দুটি প্রাইভেটকার। মৃদুলের ব্যবসায়িক অংশীদার দেবাশীষ বাগচি বলেন, ফরহাদ হোসেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী হওয়ার পর মৃদুল মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ সরকারের বিভিন্ন অফিস আদালতের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ ও পোল বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের ওষুধ সরবরাহের কাজ শুরু করেন। ফরহাদের মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে মেহেরপুরের প্রায় প্রতিটি বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজের নিয়ন্ত্রণ করত সরফরাজ হোসেন মৃদুল। মেহেরপুর শিক্ষা প্রকৌশলী, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, জনস্বাস্থ্য বিভাগসহ সবখানেই ছিল তার আধিপত্য। টেন্ডার যেইই পাক না কেন মৃদুল ছাড়া কাজ কেউই করতে পারত না। এ ছাড়া মেসার্স ফজিলাতুন্নেছা অ্যান্ড সন্স নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স করে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের অধিকাংশ কাজ বাগিয়ে নেন। মন্ত্রীর প্রভাবে কাজ করার কারণে তার সঙ্গে আমার মতপার্থক্য শুরু হয়। এ জন্যই ব্যবসা থেকে আমাকে পৃথক করে দেন।