Logo
Logo
×

আগস্টের শোকগাথা

বঙ্গবন্ধু এক অবিস্মরণীয় গ্রন্থনাম

Icon

করীম রেজা

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তাকে কতটুকু পাঠ করা হয়েছে, পাঠযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে গবেষণার দাবি রাখে। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংগ্রাম দর্শনের সমগ্রতা নিরূপণের জন্য বঙ্গবন্ধু পাঠে অভিনিবেশ জরুরি। স্বল্পায়তনে, অল্প সময়ে, সংক্ষেপে ভাসাভাসা আলোচনায় তাকে পুরোপুরি ধারণা করার চেষ্টা বিচ্ছিন্নতাদুষ্ট হতে বাধ্য। তারপরও উপযুক্ত চেষ্টা নিশ্চয়ই অব্যাহত থাকবে। আলোচ্য নিবন্ধে কিছু বিষয় ছুঁয়ে দেখার মধ্য দিয়ে ঔৎসুক্য সৃজনের প্রয়াস করা গেছে।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করে এমআর আখতার মুকুলের লেখা ‘মুজিবের রক্ত লাল’ (সাগর পাবলিশার্স, ২০০০) বইতে একটি নিদারুণ প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। ১৯৭২-এ স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। অন্যদিকে পরাজিত শক্তি নানাভাবে মুজিব হত্যার কিংবা তার সরকারের পতন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন পায়তারা শুরু করে। কমবেশি সবাই জানত, আর এখন তা প্রমাণিত। প্রমাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে, তার পরিবারের সবাইকে বাংলার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালে এমন একটি প্রসঙ্গের আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু এমআর আখতার মুকুলকে বলেছিলেন, ‘আমাকে মারতে চাস, মার। তোরা কোনোদিন শান্তি পাবি না।’

আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন না। তবুও তিনি এদেশের মানুষের মনের ভাব, আগ্রহ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতেন। তাই ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি তার দলের সর্বাত্মক সমর্থন না পেয়েও ছয় দফার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেননি। আন্দোলন করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যেমন দৃঢপ্রতিজ্ঞ ছিলেন, তেমনি সফলতা সম্পর্কে ছিলেন পুরোপুরি আশাবাদী। সেই বঙ্গবন্ধু যখন তার বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের খবর প্রতিনিয়ত শুনছিলেন, সেই অবস্থায় তার এই উক্তি আক্ষেপ নাকি অভিশাপ?

যা হোক, এই যে তিনি বলেছিলেন তোরা কোনোদিন শান্তি পাবি না; তার অবিশ্বাস্য, নির্মম মৃত্যুর পর আদতেই কি আমরা শান্তি পেয়েছিলাম? এখনো কি আমরা শান্তির সন্ধান করছি না? তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে মারতে চাস, মার’। মৃত্যুভয় তার কখনো ছিল না। যদি থাকত তাহলে একাত্তরে পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় যখন তার সামনে কবর খুঁড়ে বলা হয় ওই কবরে, ওই গর্তে তাকে কবর দেওয়া হবে, তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করেননি। উলটো অসীম সাহসী বীরের মতো বলেছেন, এক মুজিব মারা গেলে লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে।

তার অন্তরে দেশের জন্য স্বপ্ন, জনগণের কল্যাণের জন্য আকাঙ্ক্ষা, পরিকল্পনা, সর্বোপরি যদি দেশপ্রেম না থাকত, শুধু সুবিধার জন্য, ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য রাজনীতি করতেন, তাহলে ঠিকই তিনি ইয়াহিয়া কিংবা জুলফিকার আলী ভুট্টো অথবা ভারত সরকারের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করতেন। ইতিহাস সাক্ষী, তিনি তা করেননি এবং হতাশায় ভেঙে পড়েননি, লোভে দুর্বল হননি। অথবা নিজ-স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কোনো আপস মীমাংসা করেননি। যার ফলাফল আমরা দেখি-তিনি দেশে ফিরে এসেই ভারতীয় সৈনিক, যারা মুক্তি সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাদের অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। সেই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে শুধু আটকে পড়া বাংলাদেশি সেনা সদস্যসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার স্বার্থে তিনি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।

তবে তিনি ওই যুদ্ধবন্দি ফেরত চুক্তিতে স্পষ্টভাবে একটি ধারা সংযুক্ত করিয়েছিলেন, যাতে করে পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধ, মানবিক অপরাধ ও গণহত্যাজনিত অপরাধের বিচার করা হয়। পাকিস্তান সরকার চুক্তির শর্ত মেনে বিচারের অঙ্গীকার করলেও কখনোই বিচারের চেষ্টা করেনি। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই চুক্তির শর্ত পালন করার প্রশ্নই আসে না। অবশ্যই বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে দেশে না হলেও আন্তর্জাতিক আদালতে সেই যুদ্ধাপরাধীদের, গণহত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতেন। এ ধারণা মোটেই অমূলক, অবাস্তব নয়।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় হিস্যা, যা পাকিস্তানের কাছে পাওনা, তা আজ পর্যন্ত আদায় করা সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে সেই দাবি কোনো কোনো ফোরামে উত্থাপিত হলেও জোরালোভাবে তা আদায়ের কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না।

বঙ্গবন্ধু তার জীবিতকালে খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন দেশ পরিচালনার জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত, কোষাগার শূন্য একটি রাষ্ট্রকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সব রকম কৌশল তিনি প্রয়োগ করে সার্থক হয়েছিলেন। সেই সফলতা, সার্থকতা তার মৃত্যুর কাল হয়েছিল। তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য, পুনর্গঠনের জন্য নির্ভর করেছিলেন আমলা শ্রেণির ওপর। হয়তো বুঝতে পারেননি-যে যুবক, যে কিশোর, যে কৃষক সন্তান, যে ছাত্র, জীবনে কোনোদিন বন্দুক রাইফেল দেখেনি, গ্রেনেড-বোমা চোখে দেখেনি, এমনকি বন্দুক থেকে ছোড়া গুলির শব্দ শোনেনি, সেই তারাই যখন খালি গায়ে, খালি পায়ে, খালি পেটে, সামান্য কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে, দেশপ্রেমের শক্তিতে বলবান হয়ে সুশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে, তাদেরই দেশ গঠনের কাজে লাগানো দরকার। আমলাদের নয়, যারা স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানের তাঁবেদারি করেছে। তাহলে বোধকরি আজকে দেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তা আরও কয়েক দশক আগে সম্ভব হতো।

মনে করা ভুল হবে না যে, তাহলে হয়তো বঙ্গবন্ধুর অকাল মৃত্যু হতো না। কেননা যে আমলাদের তিনি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশি মনে করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই যথাযথ সততার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেনি। এসব নিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনো হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও কখনো কখনো উঠতে দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধুকে বারবার সাবধান করে দেওয়ার পরও তিনি বিশ্বাস করেননি, মেনে নেননি যে, এদেশের কেউ তাকে হত্যা করতে পারে। তিনি জানতেন তার দলের লোকদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেলে তার ক্ষতি করবে, দেশের ক্ষতি করবে, সেজন্য তিনি সেসব লোকজনকে তার কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার এ কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

আমরা আজ পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানি না স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সরকারের অন্যতম চার নেতা দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর কেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। অথবা তিনি কেন তাদের অবিশ্বস্ত মনে করছিলেন কিংবা কেউ তাকে ভুল বুঝিয়েছিল কিনা যে তারা বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠনে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দরকার তাতে বাধ সাধবেন। জানি না বঙ্গবন্ধু সন্দেহ করেছিলেন কিনা তার পরিকল্পনা মতো তাকে তারা এগোতে দেবেন না। যুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের এক ধরনের বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে বলে কান ভারি করা হয়েছিল কিনা, তাও পরিষ্কার জানা যায় না। আমরা এসব কিছুই জানি না। কেউ এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কোথাও কিছু লিখেছেন বলেও জানা যায় না।

সবকিছু বাদ দিয়ে আমরা শুধু এ আশাই করব-বঙ্গবন্ধু যেন হন চর্চার বিষয়। বঙ্গবন্ধু যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে না থাকেন। সরকারি অফিসগুলোতে মহাসমারোহে আমলাদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু কর্ণার বলে একটা অংশ সাজানো হয়েছে। সেখানে যেসব বইপুস্তক রয়েছে, সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলোর মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি প্রশ্ন করা যায় আদৌ সেসব ব্যবহার করা হবে কিনা, কীভাবে হবে? কিংবা বাস্তবে সেই কর্ণার কি ব্যবহার উপযোগী? অফিস চলাকালীন সেই বঙ্গবন্ধু কর্ণার অব্যবহৃত থাকবে ধরে নেওয়া যায়। অফিসের কাজের সময় নষ্ট করে নিশ্চয় তা কেউ করবে না। হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেখানে দেখবে-সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেসব কর্ণার, বইপুস্তক কোথায় হারিয়ে গেছে।

আমরা জেনেছি এমআর আখতার মুকুলের বর্ণনায়, ১৫ আগস্ট লন্ডন হাইকমিশন অফিসে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রদূতকে নিজে নিয়োগ দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্রদূত চোখের পলকে নিজের রূপ বদলে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি দেওয়াল থেকে নামিয়ে অভব্য ভঙ্গিতে ভাঙার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এমনকি একদল উচ্ছৃঙ্খল মানুষের অনুরোধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য ক্যামেরায় ছবি তোলার সুবিধার্থে সেই হাইকমিশনার বঙ্গবন্ধুর ছবি আবার ভাংচুর করতে পরিকল্পনামতো সাজিয়ে সহায়তা করেছেন। সুযোগ দিয়েছেন। এদের মতো লোকজন আবার ভোল পালটে ফেলেছেন। আলোচনায়, লেখায়, বক্তৃতায়, টকশোতে অনেকেই ইঙ্গিতে এদেরও কথা বলেন; কিন্তু নাম উল্লেখ করেন না বা করার সাহস পান না।

আড়ম্বর যত দেখা গেছে, তার তুলনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, তথ্যনির্ভর, ইতিহাসনিষ্ঠ একাডেমিক অনুষ্ঠানাদির খবর পত্রিকায় তেমন দেখা যায়নি। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু পাঠের দ্বারা ইতিহাসের আসল সত্য নৈর্ব্যক্তিক চোখে দেখুক, জানুক, বিচার করুক। প্রকৃত দেশেপ্রেমে সত্যসন্ধ হোক। আমরা চাইব বঙ্গবন্ধুর জীবনাচরণ, তার দর্শন, তার দেশচেতনা, তার দেশপ্রেম, সমাজভাবনা সবই আলোচিত হবে; গবেষকরা খুঁজে বের করবেন, প্রচার করবেন, প্রকাশ করবেন।

করীম রেজা : কবি, সাবেক অধ্যক্ষ ও লেখক

karimreza9@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম