Logo
Logo
×

আগস্টের শোকগাথা

নদী ও বঙ্গবন্ধু

Icon

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির শ্রেষ্ঠ সম্পদ, আমাদের অহংকার। ১৯৭১ আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাতিঘর আর ৭ মার্চ হলো মূলমন্ত্র। জাতির পিতার সেদিনের আহ্বান-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এ অমোঘ বাক্যের ওপর বিশ্বাস করে এদেশের মানুষ জীবনবাজি রেখে হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো বাঙালির বুকের ভেতর সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল আগুন জাগানো এক বিপ্লবী স্লোগান-‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। আমরা জেনেছিলাম, আমাদের গন্তব্য-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা; আমাদের সামনে ছিল একটাই নিশানা-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখো বাঙালি সেদিন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রুর মোকাবিলায়। তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ, নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সেই রক্তধারা আজও বহমান পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়। একদিনে স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। তিরিশ লক্ষ প্রাণ, দু লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম, অসংখ্য বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষা, শোক ও কষ্টের পরে এ নবসূর্যোদয়-আমাদের এ লাল-সবুজের পতাকা। এ অহংকার, এ গৌরব ও অমূল্য সম্পদ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে। আর কোনো শকুন, কোনো দেশমাতৃকাবিরোধী আপছায়া যেন ঢেকে না ফেলে বাংলাকে, সেদিকে খেয়াল রেখে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারায় থাকতে হবে এবং অনবরত সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে যেতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে নদীগুলোর অবদান রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি নদীগুলোও শামিল হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে, আশ্রয়ে, যোগাযোগে এবং গেরিলা যুদ্ধে নদীরা পাশে থেকে সাহায্য করেছে। নদী ছিল বলেই শত্রুপক্ষকে পরাজিত করা সহজ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নদীর অবদান নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র, নাটক তৈরি হয়নি। নদীকে অবহেলা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন, নদীর নাব্য কমে গেছে, এর প্রবাহ ধরে রাখতে হবে। নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। সেই সাতটি ড্রেজার থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজার বহরে আটটি ড্রেজার হয়নি। এটাই বাস্তবতা। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর নদী দখল ও দূষণ নিয়ে ভাবা হয়নি। ২০০৪ সালে লঞ্চডুবির ঘটনা দুর্ঘটনা নয়-অবহেলা। আবহাওয়া বার্তা দেওয়া হয়নি। তৎকালীন সরকার নৌদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অবহেলা করেছে। দেশের ক্ষেত্রেও অবহেলা করেছে। অনেক সরকার এসেছে এবং চলেও গেছে। কিন্তু তারা মানুষের জন্য কিছু করেনি। বারবার তারা এদেশকে কেবল লুটপাট করেছে, জনগণের ভাগ্য নিয়ে তামাশা করেছে, দেশকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছে। মাদক, সন্ত্রাস ও অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ করে যুবক-তরুণদের বিকলাঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আমরা গর্ব ও অহংকার করে বলতে পারি, বাংলাদেশ এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এক সময় একটি রাস্তা, ছোট সেতু, এমনকি কালভার্ট নির্মাণের জন্য বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন পড়ত। সেই বাংলাদেশ আজ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠা করছে। একদা যে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। এসব উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে দেখছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল মর্যাদাবান এক দেশের নাম। বাংলাদেশকে সমুন্নত অবস্থানে নিয়ে যেতে যার অবদান অপরিসীম, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। নিজস্ব অর্থায়নে সরকার গুরুত্বপূর্ণ মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে। দেশের জনগণ আজ গর্বভরে বলেন-আমাদের টাকায় পদ্মা সেতু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক ক্লাবে যুক্ত হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রথমবারের মতো যোগ হতে চলেছে বঙ্গবন্ধু টানেল। আগে মহাসড়ক ছিল না, এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলসহ ব্যাপক আধুনিকায়নের মাধ্যমে নগর যোগাযোগব্যবস্থা পালটে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত একটানা রেললাইন স্থাপন হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের ফলে আমরা পেতে যাচ্ছি একটি যুগোপযোগী উন্নত বাংলাদেশ।

দেশের নৌ ও সমুদ্রসীমানায় আছে উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা। সেসব সম্ভাবনাকে সুদক্ষ হাতে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পদ্মা সেতু ও পায়রাবন্দরের কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃত হবে, দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সুফল পাবে। সুনীল সমুদ্রসম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে সমুদ্রসম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে যা দিয়েছিলেন, তারপর আমরা আর কিছু পাইনি। বাংলাদেশ কেবল উলটো পথে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯টি জাহাজ নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১০ সাল পর্যন্ত জাহাজ ছিল ২টি। অথচ জাহাজ হওয়ার কথা ছিল কয়েকশ। উলটো পথে চলেছে বলেই ১৯টি থেকে মাত্র ২টি হয়ে গেছে। দেশরত্নের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর ছিল না, আজ ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। পায়রাবন্দর আজ দৃশ্যমান। মোংলা বন্দরে বিভিন্ন দেশের জাহাজ আসছে। এভাবে সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নৌপরিবহণ খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি, মৎস্যসম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম-একথা বিবেচনায় নিয়ে নদী রক্ষায় সার্বিক ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সার্বিক নির্দেশনায় নৌ-সেক্টর দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। নৌপথ খননে ৩৪টি ড্রেজার সংগ্রহ ও সুষ্ঠু ফেরি পারাপারের লক্ষ্যে ১৭টি ফেরি নির্মাণ করা হয়েছে। নৌপথ খননে আরও বেশি ড্রেজার সংগ্রহ এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের কার্যক্রম, নদীতীর দখলমুক্ত করা এবং নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং দখল ও দূষণ রোধে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের গতিশীলতা আনয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। মেরিটাইম সেক্টরে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং সিলেট, রংপুর, বরিশাল ও পাবনায় চারটি নতুন মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং ৬টি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে; আরও ৬টি জাহাজ সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। বিদেশি জাহাজে কর্মরত নাবিকদের জন্য মেশিন রিডেবল পরিচয়পত্র ‘আইডি কার্ড’ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দরসহ নতুন দশটি স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা পৃথিবীর যেখানেই গেছেন, বাংলাদেশকে আলোকিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কারণেই আমরা স্বপ্ন দেখছি। আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নত দেশে যাব-সেটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ধারণ করার কারণে। বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ আমরা যদি ধারণ করতে পারি, তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব। ১৯৪৯ থেকে ২০২১ সাল, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে এ ভূখণ্ডের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এ দলটি যখনই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তখনই দেশের মানুষ কিছু না কিছু পেয়েছে। প্রতিটি দেশের অগ্রগতির পেছনে রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতি যদি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দেশপ্রেমের জন্য হয়, তাহলে দেশ কখনো পিছিয়ে থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ২৪ বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, একটা সৎ ও সঠিক লক্ষ্য নিয়ে। সেজন্যই তিনি একটি দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলেন।

জাতির পিতার সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ একটা অবাধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে সম্মানের জায়গায় চলে গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন একটি গর্ব করার মতো বিষয়, তখন এদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা চলছে। এসব দেশবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : প্রতিমন্ত্রী, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম