Logo
Logo
×

আগস্টের শোকগাথা

বঙ্গবন্ধুই কালজয়ী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকবেন

Icon

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুই কালজয়ী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকবেন

বাঙালির জীবনে বঙ্গবন্ধুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তিনি আমাদের স্বপ্নের সম্রাট। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি ছাড়িয়ে তিনি প্রকৃতিরও বন্ধু হতে পেরেছিলেন। তাই তো কবি মহাদেব সাহা তার ‘শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা’য় লিখেছেন-এদেশের ফুল, ফল, গাছ, নদী, পাখিসহ প্রকৃতি ও প্রতিবেশ তার সখা বনে গেছেন। তার ভাষায়-‘শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা।’ যার রক্তে এদেশের মাটি সবুজ হয়েছে, উর্বর হয়েছে তাকে আগলে রাখে তার গণমুগ্ধ প্রকৃতি। তাই তিনি যে বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপাদান হবেন তা খুবই স্বাভাবিক। সাহিত্যের অন্যান্য শাখা-প্রশাখার মতোই উপন্যাসেও তাই তিনি সমান উজ্জ্বল।

ইংরেজ কথাসাহিত্যিক গিলবার্ট কিথ চেস্টারটন বলেছিলেন, ‘উপন্যাস কেন সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারা, কিংবা বিজ্ঞান ও মেটাফিজিক্সের গ্রন্থগুলোর চেয়ে কেন পাঠক উপন্যাসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়-এসব ভেবে আমরা প্রায়শই গলদঘর্ম হই। উত্তরটি কিন্তু খুব সরল : উপন্যাসগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় কারণ উপন্যাস বিজ্ঞানের চেয়েও বেশি সত্য।’ তিনি এমন বলেছিলেন, কারণ আমাদের চারপাশের সত্যগুলোকেই পাঠকের উপযোগী করে সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ ভাষায় কাহিনি আকারে উপস্থাপন করা হয় উপন্যাসে। উপন্যাসে একেকটি সময়কে লেখক যেভাবে ধরে রাখেন সেটিই পাঠককে আকৃষ্ট করে। সে বিচারে সব উপন্যাসই ঐতিহাসিক দলিল। আর তাই বাঙালির প্রধান এবং সারা বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম প্রধান আশা-ভরসার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন যে উপন্যাসের বিষয় হবে তা বলাই বাহুল্য। এই শোকাবহ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবসে আমাদের আখ্যানে উপন্যাসে সেই বঙ্গবন্ধু যেভাবে এসেছেন, তা নিয়ে একটি সরল বিবরণী তুলে ধরেই তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উপন্যাস বহুসংখ্যক হলেও সঙ্গত কারণেই সবগুলো পড়ার সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি। ‘নান্দনিক বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে যে গবেষণানির্ভর কাজটি আমি করছি তার জন্য যে উপন্যাসগুলো পড়েছি তার মধ্য থেকে বাছাই করা কয়টি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছি এখানে।

আমি লক্ষ করেছি, আমাদের কবিতায় বঙ্গবন্ধুর বহুমুখী নান্দনিকতা যতটা এসেছে সে তুলনায় উপন্যাসের মনোযোগ বহুলাংশে আটকে থেকেছে ১৯৭৫-এর ভয়াল ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোক আর হতাশায়। ছোট গল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ১৫ আগস্টের আগের বঙ্গবন্ধুকে তার বক্তৃতা-ভাষণে আর ঐতিহাসিক দলিলে যেভাবে পাওয়া যায়, ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ আর তার অব্যবহিত পরে বাঙালির হতবিহ্বলতা সেভাবে নথিভুক্ত হয়নি। হয়তো সেই অভাব পূরণ করতেই কথাসাহিত্যিকরা তাগিদ অনুভব করেছেন। তবে ১৫ আগস্টের আগের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাসে একেবারেই কাজ হয়নি এমন নয়।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা যায়, এ সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আনিসুল হকের ‘যারা ভোর এনেছিল’ শিরোনামের উপন্যাসটির কথা। এখানে লেখক দেখিয়েছেন ভারত-পাকিস্তানের বিচ্ছেদ এবং ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে একজন অকুতোভয় অভাজনবান্ধব নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাবের ইতিহাস। এখানে এই ভূখণ্ডের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার নান্দনিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখি গাছের ডালে বসে থাকা কাল্পনিক ব্যঙ্গমা ও ব্যঙ্গমিকে। ব্যঙ্গমা বলে ওঠে-‘দেশ স্বাধীন হইব। যুদ্ধ কইরা। সেই যুদ্ধের সময় মুজিবর আর একলা একটা মানুষ থাকব না, সাড়ে সাত কোটি মুজিবর হইয়া যাইব।’ ‘ভ্রান্ত প্রত্যুষ’ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে একটি অবাস্তব কাঠামো, সেটি যে সবার আগে বঙ্গবন্ধুই বুঝতে পেরেছিলেন-সেই কথাটিই এখানে বলা হচ্ছে। এ উপন্যাসে একইসঙ্গে গ্রামবাংলার মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের বেদনায় সমব্যথি এবং তাদের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠার ইতিহাস যেমন এসেছে, তেমনি রাজনৈতিক সংগঠক ও সংগ্রামী নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা, ক্রমবর্ধমান গণসংশ্লিষ্টতা ও অসামান্য ত্যাগের বিষয়গুলোও এক ধরনের ধারাবাহিকতায় তুলে ধরেছেন আনিসুল হক। ইতিহাস পাঠের মতোই এ উপন্যাসটি পড়ে ফেলা জরুরি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাকে গেঁথে দেওয়ার প্রচেষ্টা এই উপন্যাসে খুবই স্পষ্ট।

এরই ধারাবাহিকতায় বলা যায় মোস্তফা কামালের ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটির কথা। এখানে সুনির্দিষ্ট করে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে উপজীব্য করা হয়েছে। শুরুতেই দেখা যায় বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের বলছেন-‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশভাগ হইছে। হইছে না?...এইবার আমার এই ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান দুই ভাগ হইবো। কথাটা মনে রাইখ্যো।’ বাঙালির মুক্তির সনদের প্রণেতা বঙ্গবন্ধুকে উপন্যাসের ভাষায় এভাবেই অল্প কথায় তুলে ধরেছেন মোস্তফা কামাল। উপন্যাসজুড়েই দেখতে পাই কিভাবে বঙ্গবন্ধু নিরলস কাজ করে গেছেন এদেশের মানুষকে ছয় দফার মর্মার্থ বোঝাতে। শেষে তাই পাকিস্তানি অপশাসকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর বলা ‘কত নিছো? কবে দেবা? কবে যাবা?’-এই কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, এগুলো হয়ে ওঠে সবার দাবি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফাকে কেবল কাঠখোট্টা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভুল হবে। তার অসামান্য নেতৃত্ব গুণে এই ছয় দফা প্রকৃত অর্থেই পূর্ব বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি হয়ে উঠেছিল। আর এ বিষয়টিই মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামাল অবশ্য সমসাময়িক অন্যান্য রাজনীতিকদের ওপরে আলো ফেলেছেন। তবে তার উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে বরাবরই রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। একই কথা খাটে মোস্তফা কামালের আরেকটি উপন্যাস ‘অগ্নিকন্যা’তেও। যদিও মতিয়া চৌধুরী হয়ে ওঠেন উপন্যাসের মূল চরিত্র, তবুও সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুর মতো সেই সময়ের চিরত্রগুলোর সন্ধান পাই।

বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের একটি অংশ বেশ উজ্জ্বলভাবে স্থান করে নিয়েছে এ উপন্যাসে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অনেক কথা, অনেক দৃশ্যপট এ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। জায়গা করে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রধান সব চরিত্র শেখ ফজিলাতুন্নেসা, শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল অবলীলায় ঢুকে পড়েছেন ‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসের মূল মঞ্চে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোই একদিন এদেশের ধ্রুপদী উপন্যাসের অবয়বে অসামান্য নান্দনিকতায় স্থান করে নেবে আমাদের সাহিত্যে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্য ভাষায় লেখা উপন্যাসের মধ্যে পড়ার সুযোগ হয়েছে রবার্ট পেইনের ‘The Tortured and the Damned’, যার বাংলা অনুবাদ করেছেন সিদ্দিকুর রহমান। বাংলা অনুবাদের শিরোনাম ‘সেই দুঃসময়’। স্বভাবতই পশ্চিমের চোখে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শহিদ হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়েছিলেন ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের অবিংসবাদিত নেতা হিসাবে। তাই রবার্ট পেইনের উপন্যাসেও বঙ্গবন্ধু এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসাবে। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের পালিয়ে যেতে বললেও নিজের জীবন নিয়ে ভয় করেননি। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের বঙ্গবন্ধুর বয়ানে লেখক লিখেছেন-‘আমাকে খুঁজতে গিয়ে ওরা সারা নগরী জ্বালিয়ে দেবে। আমি চাইনে, কেবল আমার জন্য এমন ভয়াবহ পরিণতি ঘটুক। আর আমাকে গ্রেফতার করে কোনো লাভ হবে না যেমন অতীতেও লাভ হয়নি। আমাকে হত্যা করা হলে হাজারো শেখ মুজিব প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসবে।’ অল্প কটি বাক্যে লেখক দেখিয়েছেন দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মনে মুক্তির যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিলেন, তার ওপর তার নিজের ছিল কী ভীষণ আস্থা!

সম্ভবত আমাদের সময়ের বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক মাধ্যমে অনেক কাজ করেছেন তিনি। তার অন্তত দুটি উপন্যাসে প্রবলভাবে হাজির আছেন বঙ্গবন্ধু। একটি ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, অন্যটি তার শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’। দুই জায়গাতেই তিনি যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এদেশের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হৃদ্যতা ও তাদের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টি। যেমন : জোছনা ও জননীর গল্পে পাকিস্তানি গোয়েন্দা অফিসার তার অধীনস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোবারককে বলছেন-‘শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হওয়া খুবই সহজ কাজ। এ মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালির প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি সমস্ত বাঙালিকে বিশ্বাস করেন এবং আমরা প্রতিটি বাঙালিকে অবিশ্বাস করি। তিনিও ভুল করছেন। আমরাও ভুল করছি। ভুলের মাশুল তিনি যেমন দিবেন। আমরাও দেব।’ বাস্তবের সঙ্গে এ কথাগুলোর যে সাজুয্য তা একইসঙ্গে নান্দনিক ও বেদনাদায়ক। কারণ শেষ পর্যন্ত যাদের বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, তাদের মধ্যেই কারও কারও ষড়যন্ত্রে তিনি শহিদ হন। একই বিষয় আবার উঠে এসেছে হুমায়ুনের ‘দেয়াল’ উপন্যাসে। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে ছদ্মবেশে এসে জানান তার কাছের কিছু মানুষই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তখন বঙ্গবন্ধুর বয়ানে লেখক লিখেছেন-‘যাদের কথা বলছেন, তারা আমার সন্তানসম। এই আলোচনা আমি চালাব না।’ নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, ওই অপসন্তানদের হাতেই তিনি নিহত হয়েছিলেন।

ভয়াল ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ শহিদ হওয়া নিয়ে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী উপন্যাসগুলোর একটি সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের একরাত’। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দিগুলোকে ভিত্তি করেই উপন্যাসটি দাঁড়িয়েছে। সাক্ষীদের জবানিতে লেখা এ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বেদনায় প্রায়শই বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবু যে দিকটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখানে, তা হলো ওই চরম দুর্বিপাকেও বঙ্গবন্ধুর ধীরস্থির থাকার বিষয়টি লেখক তুলে এনেছেন দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে। আসলেই সারাজীবন বঙ্গবন্ধু সংকটে বিহ্বল না হয়ে ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তারই প্রতিফলন লেখক এখানে ঘটিয়েছেন ভয়াল ১৫ আগস্টের বর্ণনায়। হামলাকারীদের মুখোমুখি হতে বঙ্গবন্ধু যখন বেরুচ্ছিলেন তখন পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করে তাকে বলতে দেখি-‘ওরা যদি আমাকে মারতে আসে তাহলে এ ঘরের দরজা ভেঙেই ওরা আমাকে মারবে। তার আগে আমাকে জানতে হবে ওরা কি চায়। কেন এসেছে?’ পাশাপাশি এ উপন্যাসের বড় আকর্ষণ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা। রেণু নামেই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিকে সমানতালে আলোকিত ও লক্ষ্যধর্মী করে রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারিয়ে ফেলার অব্যবহিত পরে বাঙালির প্রতিক্রিয়া নিয়ে লেখালেখির মধ্যে উল্লেখ করতে চাই সৈয়দ শামসুল হকের ‘দুধের গেলাসে নীল মাছি’ উপন্যাসটির কথা। প্রোটাগনিস্ট মাহতাব লন্ডনে কর্মরত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পায়। স্বভাবতই বিহ্বল হয়ে পড়ে। ‘দুধের গ্লাসে নোংরা নীল মাছি’র চিত্র কল্পনা করতে করতে তার বমি পায়। সে প্রকৃত অর্থেই দিশেহারা হয়ে পড়ে। যেমনটি আসলেই সে সময় ঘটেছিল লাখো-কোটি বাঙালির ক্ষেত্রে। তবে এ সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে বড় হয়ে উঠেছে উপন্যাসের শেষে লেখক প্রোটাগনিস্টের লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে প্রত্যয় দেখিয়েছেন সেটি। উপন্যাসের শেষভাগে মাহতাব তার প্রেমিকা নিকিকে লেখা কবিতায় বলে-‘বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভিজিয়া গিয়াছে বাংলাদেশ, আমি সেই বাংলাদেশে ফিরিয়া যাইব, ফিরিয়া যাইতে চাই। বমন যদি করিতেও হয়, তবে বমন করিব আমার অক্ষর, আমার শব্দ, আমার ক্রোধ, আমার আগুন।’ আসলেই তো বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর আমরা বিহ্বল হয়েছিলাম। তবু মনে-মননে চিন্তায়-চেতনায় বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেছি। তাই বহু সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধু আবারও আমাদের জাতীয় চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠেছেন।

এ ছাড়াও আরও অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছে বা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এ মুহূর্তে মাশরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’ উপন্যাসটির কথা না বললেই নয়। পরাবাস্তবতার পরশ লেগে আছে এই ভিন্নধারার উপন্যাসে। এ ঔপন্যাসিক খুঁজে বেড়ান পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দূর ইতিহাসের নিয়ান্ডারথাল মানুষের প্রকৃতির রোষে নির্মূল হওয়ার বেদনার্ত আখ্যানের কী সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের তল খুঁজতে গিয়ে নাচার তিনি। লেখকের মনে তাই প্রশ্ন জেগেছে, কেন সভ্যতার সঙ্গে সহিংসতার এমন গভীর সংযোগ? কেন পৃথিবীর বর্বরতার গভীরে এমন মৃত্যুময়তা? তার উপন্যাসের নির্যাস মেলে দুই সত্যে-প্রথমত, মানুষের ভালোবাসার সক্ষমতা খুবই সীমিত। এবং দ্বিতীয়ত, তার পাশবিকতা ও নির্মমতা অসীম। এই সত্য মিলে পাঠকের মনকে বিষাদে ভরে ফেলে ‘আগস্ট আবছায়া’। নিঃসন্দেহে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক রূপরেখায় আরও অনেক উপন্যাস লেখা হবে আমাদের নতুন প্রজন্মের লেখকদের হাতে। সেই সুদিনের প্রত্যাশায় রইলাম।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক; সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম