জ্বালানির মহাদুর্নীতি কেন আড়ালে?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. এম শামসুল আলম
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![জ্বালানির মহাদুর্নীতি কেন আড়ালে?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/08/M-Samsul-Alam-67a67a90a1ee9.gif)
জুলাই বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ এক পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবা ও করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান নীতি-কৌশলগুলো সময়োপযোগী করে নেওয়ার এখনই সময়। অতীতে অনেকবারই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কোনো কোনোবার সরকার পরিবর্তনও হয়েছে। ’৭১ সালে রাষ্ট্রেরই পরিবর্তন হলো। কিন্তু এবারকারটি একেবারেই ভিন্ন। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সরকারের জন্য রাষ্ট্রকাঠামোগত সংস্কার ও বিদ্যমান নীতি-কৌশলগুলো ঢেলে সাজানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে এ পরিবর্তন, যা বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
অতএব, জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে নীতি-কৌশলগুলো পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে যদি না পারা যায়, তাহলে আগস্ট বিপ্লবের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। অতীতে জ্বালানি খাত পরিচালনা ও উন্নয়নে যেসব নীতি-কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে, তাতে জ্বালানি নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘটেছে। সঠিক তথা ন্যায্য ও যৌক্তিক মূল্যহারে ভোক্তার জন্য বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রাথমিক জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসপ্রাপ্তির যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
দেশের জ্বালানি তথা গ্যাস-কয়লা রপ্তানি দেশের মানুষ জীবন ও রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ করলেও সে সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিবর্তে বিগত সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তরল জ্বালানি ও কয়লা আমদানির প্রতিই বেশি আগ্রহী হয়। এমন আগ্রহ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে রীতিমতো সাংঘর্ষিক। ২০১০ সালে প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর আওতায় বিগত সরকারের আমলে প্রতিযোগিতাবিহীন ব্যক্তিখাত বিনিয়োগে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ একদিকে বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত থাকে, অন্যদিকে সরবরাহ ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধিতে সরকারি ভর্তুকি ও ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে দীর্ঘদিন হলো নিষ্পত্তি হয়েছে। অথচ সমুদ্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
আগে জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ করা হতো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনের আওতায় বিইআরসির দ্বারা গণশুনানির ভিত্তিতে। এতে অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতো। কিন্তু বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ নিজেই অংশীজনদের অংশগ্রহণ ছাড়া তরল জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ করা অব্যাহত রাখে। ফলে তরল জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ সম্পর্কিত তিনটি প্রবিধানমালা জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ কর্তৃক ২০১২ সাল থেকে আটকে রাখার বিরুদ্ধে এবং ৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখে তরল জ্বালানির (ডিজেল ও কেরোসিন) কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে নির্ধারিত মূল্যহার বিইআরসি আইনের ধারা ২২ ও ৩৪ অনুযায়ী রিভিউয়ের আদেশ প্রদানের জন্য ক্যাবের দায়েরকৃত ১০৫০৮/২০২১ নং রিট মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট রুলনিশি ইস্যু করেন। মামলাটি এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
এ অবস্থায় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০২৩-এর দ্বারা সরকার তথা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা হাতে নেয়। ওই সংশোধিত আইনে ধারা ৩৪ক সংযোজনের মাধ্যমে সরকার মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে ‘কমিশন কর্তৃক প্রবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সরকার এনার্জির মূল্যহার নির্ধারণ করিতে পারিবে’-এ কথাও সংশোধনীতে সংযোজন করা হয়। বর্তমান সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এ সংশোধনের শুধু ধারা ৩৪ক রহিত করে এবং তরল জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের হাতেই রয়ে যায়। বিগত সরকারের ধারাবাহিকতায় প্রবিধান গেজেট না করে আটকে রেখে বর্তমান সরকারও বিইআরসির পরিবর্তে জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ করা অব্যাহত রাখে। ফলে তরল জ্বালানিতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় সমন্বয় এবং লুণ্ঠনমূলক রাজস্ব ও মুনাফা আহরণ অব্যাহত থাকে।
বর্তমান সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ ২০২৪ জারি করায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রহিত হয়। তবে অধ্যাদেশে দফা ২(২)(ক) ও (খ) সংযোজন করে ওই আইনের আওতায় কৃত সব কার্যক্রমের আইনি বৈধতা দিয়ে সুরক্ষা তথা দায়মুক্তি দেওয়ায় বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি খাত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত অবাধ লুণ্ঠন এ সরকারের আমলে সুরক্ষা পেল। ভোক্তারা জ্বালানি সুবিচার বঞ্চিত হলো। ফলে রহিতকরণ অধ্যাদেশে সংযোজিত দফা ২(২)(ক) ও (খ) বাতিলের জন্য ক্যাব হাইকোর্টে ১৫১৬১/২০২৪ নং রিট মামলা দায়ের করেছে।
পৃথিবীর জ্বালানির প্রায় সর্বাংশের উৎস সূর্য হলেও পৃথিবীজুড়েই ভূমি ও সাগরের অভ্যন্তরে যে পরিপূরক জ্বালানি সম্পদ রয়েছে, তার মালিকানা রাষ্ট্র তথা জনগণের। কিন্তু যারা বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি সম্পদ জনগণের নামে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও সমর্থনে লেনদেন করেছেন, তারা জনগণের অধিকার খর্ব করে কতিপয় দুর্ভেদ্য অধিকার বা অলিগার্ক সৃষ্টি করেন। এ অবস্থার পরিবর্তন করা দরকার সবার আগে। অধ্যাদেশে সংযোজিত ওই দফা ২(২)(ক) ও (খ) বাতিল না হলে এ পরিবর্তন হবে কীভাবে? অতীতের লুণ্ঠনের বিচার না হলে আগামীতে জ্বালানি খাত লুণ্ঠনমুক্ত হবে কীভাবে? ক্যাব সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালের দ্বারা বিগত ১৫ বছরের লুণ্ঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত সুনির্দিষ্ট চারজন বিশিষ্ট অপরাধীসহ সব জ্বালানি অপরাধীর বিচার চায়। লুণ্ঠনমুক্ত জ্বালানি খাত উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্যাব বিইআরসি আইনের আমূল সংস্কার চায় এবং ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪-এর ভিত্তিতে বাণিজ্যিক নয়, সরকারি সেবা খাত হিসাবে জ্বালানি খাত উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য জাতীয় জ্বালানি নীতি চায়।
জ্বালানি আমদানি, অনুসন্ধান ও উৎপাদনবিষয়ক ব্যয়ের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখার ক্ষমতা আইনে বিইআরসিকে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ছাড়া সম্পূর্ণ সাপ্লাই চেইন রেগুলেটরি সংস্থা বিইআরসির আওতাবহির্ভূত। ভোক্তার জ্বালানি অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হলে সমগ্র সাপ্লাই চেইন বিইআরসির আওতায় আনা আবশ্যক।
তাই ক্যাবের প্রস্তাবিত জ্বালানি নীতিতে বিইআরসি আইন সংস্কার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জ্বালানি মানবজীবনের জন্য একটি আবশ্যিক পণ্য বা সেবা। জ্বালানি তথা জ্বালানি নিরাপত্তার ঘাটতি, অর্থাৎ যে কোনো মৌলিক চাহিদার (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা চিকিৎসা, বাসস্থান) ঘাটতি যতটা না বিপজ্জনক, এর থেকেও জ্বালানি ঘাটতি ভয়াবহ বিপজ্জনক। তাই এ ঘাটতি সৃষ্টি করা সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল। সুতরাং, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যায্য ও যৌক্তিক মূল্যে জ্বালানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্র তার এ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। বর্তমান সরকারের আমলে এরই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা আজও ভয়াবহ বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবয়ব, বিশেষ করে জ্বালানি খাত যদি লুণ্ঠনমূলক শোষণের চিত্র ধারণ করে, তাহলে দুটি বিষয় অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এর একটি হলো জ্বালানি অবিচার এবং অন্যটি জ্বালানি দারিদ্র্য। জ্বালানি অবিচার এবং জ্বালানি দারিদ্র্য অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ জ্বালানি অবিচার থেকে জ্বালানি দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে জ্বালানি দারিদ্র্য বলতে আধুনিক জ্বালানি সেবাগুলো নাগরিকের প্রবেশাধিকারের অভাবকে বোঝায়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, জীবনমান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল সূত্র হচ্ছে জ্বালানি সেবায় অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত থাকা। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান প্রতিটি মৌলিক অধিকারই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জ্বালানিনির্ভর। জ্বালানি দারিদ্র্য বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে একজন ব্যক্তি রান্নার প্রয়োজনে বছরে মাথাপিছু ৩৫ কেজি এলপিজি পায় না বা ব্যবহার করতে পারে না অথবা বার্ষিক মাথাপিছু ১২০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করার মতো সামর্থ্য তার থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্বালানিতে প্রবেশাধিকার থাকলেও ব্যবহারে প্রবেশাধিকার অধিকাংশ ভোক্তার খুবই সীমিত। অর্থাৎ জ্বালানির ওপর অধিকাংশ ভোক্তা স্বত্বাধিকার অর্জনে সক্ষম নয়। ফলে প্রবেশাধিকার সেখানে অর্থহীন। বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে জ্বালানি নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ফলে দারিদ্র্যবিমোচনের ধারণা অসম্পূর্ণ।
জ্বালানি মানুষের মৌলিক অধিকার। কোনো ভোক্তা প্রাপ্ত বিদ্যুৎ বা অন্য কোনো জ্বালানি দিয়ে কী করবেন, তা আলাদাভাবে বাছাই করার সুযোগ নেই। একজন ভোক্তা প্রাপ্ত বিদ্যুৎ দিয়ে ঘরের বাতি জ্বালাতে পারেন অথবা ঘরের হিটিং চালাতে পারেন অথবা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে অন্য কোনো কাজ করতে পারেন, এটি একান্তই তার নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ ব্যাপারে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু ভর্তুকি ও জ্বালানি ঘাটতি বা স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে তা সরকার কর্তৃক প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত।
সাধারণ মানুষের জন্য জ্বালানি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জন করতে চাই। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই অর্জন করা সম্ভব নয়, যদি ভোক্তাশ্রেণি নির্বিশেষে ক্রয়ক্ষমতায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায়। অথচ আমরা বছরের পর বছর জ্বালানি বুভুক্ষার শিকার। পুষ্টিহীন অর্থনীতির কঙ্কালসার দশায় সরকার ডলার ও টাকার তীব্র সংকটের কারণে ভয়ানকভাবে জ্বালানি নিরাপত্তাহীন।
জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যহার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় ভোক্তা ও সরকার উভয়ই এখন রীতিমতো জ্বালানি অধিকার বঞ্চিত এবং জ্বালানি দারিদ্র্যের শিকার। অথচ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন ২০০৩ ছাড়াও বিভিন্ন আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র তার প্রত্যেক নাগরিকের জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করেছে।
উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত সরকারের আমলে তা মোটেও কার্যকর ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলেও সে পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কোনো জ্বালানি অপরাধী চিহ্নিত হয়নি। কাউকেই এখনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যিনি অভিযুক্ত, তাকেই তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ফলে বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় ও মূল্যহার উভয়ই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করায় ভোক্তা লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। এর কোনো প্রতিকার ও প্রতিরোধ হয়নি। এখনো তা অব্যাহত ও সুরক্ষিত। ন্যূনতম ব্যয়ে জ্বালানি সরবরাহ ও ন্যায্য মূল্যহারে জ্বালানি প্রাপ্যতা এখনো বিপন্ন এবং ভোক্তা জ্বালানি অধিকার বঞ্চিত।
সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে জ্বালানি খাতে দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়। সরকার সমর্থক একটি গোষ্ঠী জ্বালানি খাতের উন্নয়ন ও জ্বালানি সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধির নামে বিগত সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুণ্ঠন করেছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এর প্রমাণ খানিকটা পাওয়া যায়। জ্বালানি সরবরাহ চেইনের পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা হলে তিতাস গ্যাসের মতো সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠে দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য পরিচালক। আবার সরকারের দুর্নীতির অংশীদার হিসাবে যখন ব্যক্তি খাত এগিয়ে আসে, সেখানেও কোনো জবাবদিহিতা সৃষ্টি হয় না। বরং তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ে। ফলে একচেটিয়াবাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। বিগত সরকারের আমলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে লুণ্ঠনের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে জ্বালানি সংস্কার জরুরি। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে জ্বালানিতে লুণ্ঠন ও দুর্নীতি চলছে, চলবে-ভোক্তাদের এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
অন্য যে কোনো অবকাঠামো খাতের চেয়ে বিদ্যুৎ খাতে নগদ অর্থ সৃষ্টির সুযোগ অনেক বেশি থাকে। বিশ্বব্যাংক বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতিতে তিনটি বিভাজন শনাক্ত করেছে। এগুলো হচ্ছে : ১. ছোট দুর্নীতি (যেমন, মিটার রিডার ও কারিগরি কর্মচারীদের দুর্নীতি); ২. মাঝারি দুর্নীতি (যেমন, কোম্পানি ম্যানেজার ও মধ্যস্তরের আমলা ও তাদের প্রশ্রয়ে সংঘটিত দুর্নীতি) এবং ৩. মহাদুর্নীতি বা গ্রান্ড করাপশন (পাবলিক বা প্রাইভেট কোম্পানিকে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার দেওয়ার বিনিময়ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে গোষ্ঠীর ও নিজের নামে বিশাল অঙ্কের অর্থ তুলে নেওয়া, যার বড় অংশই সুবিধাদানকারীর নির্ধারিত বৈদেশিক অ্যাকাউন্টে পাচার হয়। মহাদুর্নীতি সরকারের শীর্ষ মহলের আশীর্বাদ ছাড়া করা সম্ভব নয়। এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে জ্বালানি খাতের দুর্নীতিতে প্রতিষ্ঠিত।
বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি খাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর আওতায় প্রায় দেড় দশক ধরে মহাদুর্নীতি চলেছে। বর্তমান সরকারের আমলে ওই আইন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে রহিত করা হলেও সেসব মহাদুর্নীতিকে এ অধ্যাদেশেই সুরক্ষা তথা দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ’৯০-এর দশকে ইউক্রেনে সংঘটিত মহাদুর্নীতির কথা বিশ্বব্যাংকের কথায় এসেছে এবং তাতে বলা হয়েছে, ছোট ও মাঝারি দুর্নীতি যত সহজে চোখে পড়ে, মহাদুর্নীতির বেলায় তা ঘটে না। রাষ্ট্র আড়াল করে। আমাদের ক্ষেত্রেও কি রাষ্ট্র তা আড়াল করছে না?
লেখক : ডিন, ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব