Logo
Logo
×

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা

উন্নয়নের জন্য চাই সঠিক পরিসংখ্যান

Icon

ড. মোস্তফা কে মুজেরী

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উন্নয়নের জন্য চাই সঠিক পরিসংখ্যান

উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হলেই তাকে সার্বিক উন্নয়ন বলা যায় না। উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক সবকিছুর উন্নয়নকেই বোঝায়। অর্থাৎ উন্নয়ন বলতে মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি খাতের অগ্রগতিকে বোঝায়। কাজেই টেকসই ও সুষম উন্নয়ন অর্জন করতে হলে এসব বিষয়ের সমন্বিত উন্নয়ন প্রয়োজন। উন্নয়ন এমন একটি বিষয়, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা। প্রতিটি দেশই উন্নয়ন কামনা করে; কিন্তু চাইলেই তা অর্জন করা যায় না। উন্নয়ন অর্জন করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। আর সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হলে চাই সঠিক পরিসংখ্যান। উন্নয়নের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। আর গবেষণার সঠিক ফলাফল পেতে হলে নির্ভুল পরিসংখ্যানের কোনো বিকল্প নেই।

উন্নয়ন বিষয়টি এমন একটি ইস্যু বা ধারণা, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। আজ থেকে ৫০ বা ৬০ বছর আগে উন্নয়নের যে ধারণা ছিল, এখন তা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য গবেষণা কার্যক্রমকেও উন্নয়ন ও পরিমার্জন করতে হয়। সাধারণভাবে আমাদের অনেকের মাঝে এমন একটি ধারণা রয়েছে যে, উন্নয়ন হচ্ছে মূলত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন বা অর্জন। যেমন-জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কোঝায় না। উন্নয়ন বলতে আমরা মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি বা পরিবর্তনকে বুঝি। অর্থাৎ দেশের জনগণের সত্যিকার কল্যাণ সাধন হলে তাকে উন্নয়ন বলা যেতে পারে। যেমন, কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হলো, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারল না, তাহলে তাকে জনকল্যাণমূলক ও সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া কোনোভাবেই টেকসই ও কার্যকর উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা যত উন্নয়ন, গবেষণা বা বিশ্লেষণের কথাই বলি না কেন, সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া তা কার্যকরভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। তথ্য ও উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেই তথ্য ও উপাত্ত যদি সঠিক ও নির্ভুল না হয়, তাহলে গবেষণা বা উন্নয়ন কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে পারে না। তথ্য-উপাত্ত যদি সঠিক না হয়, তাহলে আমরা বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারব না। আর সেটা জানা না গেলে কোনোভাবেই সঠিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব নয়। গবেষণা বা সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে যে কোনো সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ভিত্তিটাই যদি সঠিক না হয়, তাহলে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে কিভাবে? বহুতল ভবন নির্মাণ করার জন্য যেমন সবার আগে মজবুত ফাউন্ডেশন তৈরি করতে হয়, ঠিক তেমনি কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়ার জন্য সঠিক পরিসংখ্যানের আবশ্যকতা রয়েছে। পরিসংখ্যান যদি সঠিক না হয়, তাহলে কোনো গবেষণা বা পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। আর গবেষণা বা পরিকল্পনা যদি সঠিকভাবে প্রণীত না হয়, তাহলে তা থেকে আমরা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে পারব না। যদি সঠিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তাহলে যে ফলাফল পাওয়া যাবে, তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। গবেষণা বা বিশ্লেষণ যা-ই বলি, উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক পরিসংখ্যানের আবশ্যকতা রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যিনি গবেষণা করেন তিনি নিজেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়-কারণ এ ধরনের গবেষণার পরিসর হয় খুবই ছোট। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে গবেষক নিজে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ না করে সেকেন্ডারি সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। যেমন, বাংলাদেশের গবেষক ও পরিকল্পনাবিদরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ এটা রাষ্ট্রীয় সংস্থা। রাষ্ট্রীয় সংস্থার ওপর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আস্থা থাকবে। তাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তৈরির ব্যাপারে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকর বা অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যান উপস্থাপিত না হয়। যেমন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যদি সঠিকভাবে তাদের কাজটি সম্পাদন না করে, তাহলে জনসংখ্যা বেশি অথবা কম হতে পারে। অতীতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রণয়ন ও উন্মুক্ত করেছে, তার গ্রহণযোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান স্ফীত করে দেখানো হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। যেমন, প্রতিবছর উন্নয়ন সহযোগীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যের কোনো মিল থাকে না। পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব প্রদর্শন করে, উন্নয়ন সহযোগীরা তার চেয়ে এক থেকে দেড় শতাংশ কম প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করে। বছরান্তে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কেউ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে না। তাহলে আমরা কার দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্বাস করব? একটি নির্দিষ্ট বছরে কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তো ভিন্ন হতে পারে না। আবার একইভাবে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশ করে থাকে, তা বাস্তব অবস্থার চেয়ে কম বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই না। অতীতে কী হয়েছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা। তাদের উচিত হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অর্জনগুলো নির্মোহভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উপরের মহলের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে পরিসংখ্যান কমিয়ে বা বাড়িয়ে দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আগামী দিনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। এজন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে দক্ষ লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। তারা যাতে কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সঠিক তথ্য-পরিসংখ্যান জাতির সামনে তুলে ধরতে পারে, তেমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা সঠিক তথ্য পেতে চাই, তা যেমনই হোক না কেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কখনোই সঠিক পরিকল্পনা প্রণীত হতে পারে না। আর সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা না গেলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে এসব ইস্যুতে যে পরিসংখ্যান প্রণীত হয়, একে শতভাগ সঠিক বলে মনে করা যায় না। যেমন, কালোটাকার পরিমাণ, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কত টাকা মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে অথবা আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির পরিমাণ কত-এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ যারা অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, তারা কখনোই কারও কাছে তাদের অর্থের পরিমাণ এবং আয়ের সূত্রগুলো প্রকাশ করে না। এসব অর্থের হিসাব সংরক্ষণের মতো কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। কাজেই কেউই এসব ইস্যুতে একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান প্রদান করতে পারবে না। তবে বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে কিছুটা অনুমান করা যায় সমস্যার গভীরতা কতটা।

একটি দেশ থেকে প্রতিবছর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে এর সঠিক তথ্য আমরা সরাসরি পাই না। তবে নানা সোর্স থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করা যেতে পারে মাত্র। অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং বা কালো টাকা যেহেতু অনৈতিক কাজ, তাই মানুষ চেষ্টা করে কীভাবে এগুলো গোপন রাখা যায়। কারও কাছে যেন প্রকাশ না পায়। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে বলে কোনো কোনো সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে। পণ্য আমদানিকালে ওভার ইনভয়েসিং এবং পণ্য রপ্তানিকালে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এর সঠিক পরিমাণ কেউই বলতে পারবে না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যাচাই করে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে প্রতিবছর কী পরিমাণ অর্থ আমদানি ব্যয়ের আড়ালে পাচার হচ্ছে এবং কী পরিমাণ অর্থ রপ্তানির আড়ালে বিদেশে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত এ অর্থের পরিমাণ বেশি-কম হতে পারে। তবে এর মাধ্যমে আমরা সমস্যার গভীরতা অনুমান করতে পারি। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এক প্রেসিডেন্ট বলেছেন, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী যে মানি লন্ডারিং হয়, তার পরিমাণ বিশ্ব জিডিপির ২ থেকে ৫ শতাংশ, টাকার অংকে যার পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলার। এ পরিসংখ্যান শতভাগ নিশ্চিত, এটা বলা যাবে না। তবে এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের ভয়াবহতা অনুমান করা যেতে পারে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম