ব্যাংক খাতে নৈতিকতার চর্চা জরুরি

ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে নানা জটিল সমস্যায় জর্জরিত। এ খাতের সমস্যার জন্য আমরা নানা কারণকে চিহ্নিত করে থাকি; কিন্তু ব্যাংকে যারা কাজ করেন, অর্থাৎ ব্যাংকার, তাদের ভূমিকা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না। ব্যাংক খাতের উন্নতির জন্য ব্যাংকারদের দক্ষতার বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ একজন ব্যাংকার যদি অভিজ্ঞ ও দক্ষ না হন, তাহলে তিনি গ্রাহকদের সার্ভিস প্রদান করবেন কীভাবে? একজন ব্যাংকার যদি সৎ ও দক্ষ হন, তাহলে তার দ্বারা নৈতিকতাবিরোধী কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে একটি দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয়। আর ব্যাংকিং কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করে কর্মরত কর্মীদের সততা ও দক্ষতার ওপর। ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে গ্রাহকের সন্তুষ্টি ও আস্থা। কোনো কারণে গ্রাহক যদি কোনো ব্যাংকের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তাহলে সেই ব্যাংকের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। গ্রাহকের আস্থার বিষয়টি কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কর্মীদের দক্ষতা। কোনো ব্যাংকের কর্মীরা যদি দক্ষ ও সৎ হন, তাহলে সেই ব্যাংকের প্রতি সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে। পুঁজির পর্যাপ্ততা এবং কর্মীদের নৈতিকতা একটি ব্যাংক সফল হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত। কাজেই ব্যাংক খাতে নৈতিকতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। অর্থ অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি উপকরণ। কোনো মানুষই আস্থাহীন স্থানে অর্থ বিনিয়োগ অথবা সংরক্ষণ করতে চাইবে না। আমানত সংগ্রহ, পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাংক কর্মীদের নৈতিকতা প্রদর্শন করতে হয়। কোনো কারণেই নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা চলতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংক খাতে আস্থা ও নৈতিকতা কীভাবে সৃষ্টি হবে? এ খাতের সব কর্মীকে ডেকে এনে প্রশিক্ষণ দিলেই নৈতিকতা সৃষ্টি হবে না। নৈতিকতা প্রত্যেক কর্মীর আচরণে প্রমাণ করতে হবে এবং নৈতিকতার বিষয়টি ‘টপডাউন’ প্রক্রিয়া। অর্থাৎ ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে নিম্নপর্যায়ের প্রত্যেক কর্মীর মধ্যে সততা ও নৈতিকতা থাকতে হবে। উচ্চপর্যায়ে যারা কর্মরত থাকবেন, তাদের সততা ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেউ সৎকর্ম করলে তাকে পুরস্কৃত এবং অসৎকর্ম করলে তাকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নৈতিকতার প্রশ্নে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে যদি অসৎ ও অনৈতিকতা চর্চা হয়, তাহলে নিচের দিকে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। উপরে অসৎ কর্মচর্চা হলে, সেই প্রতিষ্ঠানের নিচের দিকের কর্মীদের মধ্যে নৈতিক আচরণ প্রত্যাশা করা যায় না। অর্থাৎ উপদেশ নয়, আচরণ দিয়ে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একজন কর্মী যদি দেখতে পান তার ‘বস’ সারা দিন ঘুরে বেড়ান এবং বিভিন্নজনের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের নিচের দিকের কোনো কর্মীর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সততা ও নৈতিকতা প্রত্যাশা করা যায় না। অনেকেই মনে করেন, প্রশিক্ষণ দিলেই একজন কর্মীর মধ্যে নৈতিকতা জাগ্রত হবে; আসলে এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। একজন কর্মী সবসময় লক্ষ করেন তার বস কী করেন, কীভাবে চলেন। তিনিও বসকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন কর্মীকে হয়তো নৈতিকতার বিভিন্ন দিক বোঝানো যেতে পারে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি নৈতিকতা চর্চা না করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে সততা ও নৈতিকতা জাগ্রত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদি কেউ দেখেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অসৎ কাজ করলে বা নৈতিকতা বিসর্জন দিলেও কোনো শাস্তি হয় না, তাহলে তার মধ্যেও অনৈতিক কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। আমি মনে করি, যারা টপ লেভেল এক্সিকিউটিভ আছেন, তাদের চূড়ান্ত মাত্রায় নৈতিক হতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলেই প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মীরাও সততা ও নৈতিকতার চর্চা করতে বাধ্য হবেন।
দেশের ব্যাংক খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতা। সেপ্টেম্বর-২০২৪ কোয়ার্টারে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ব্যাংকগুলোর মোট ছাড়কৃত ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এটি খেলাপি ঋণের দৃশ্যমান হিসাব মাত্র। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার মতো হবে। এ খেলাপি ঋণ সৃষ্টিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নৈতিকতা অনেকাংশে দায়ী। কোনো ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে যাচাই করতে হয়, যে প্রকল্পে ঋণদানের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যাশ ফ্লো হবে কিনা বা রিটার্ন আসবে কিনা, যা থেকে প্রতিষ্ঠানটি গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ বন্ধক রাখলেই ঋণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঋণ আবেদনকারীরা গৃহীত ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক দেন, তা অতিমূল্যায়ন করা হয়। ফলে ব্যাংক চাইলেও সেই সম্পদ নিলামে বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করতে পারে না। যে প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ দেওয়া হবে, তা যদি লাভজনকভাবে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে সেই প্রকল্পের অনুকূলে ঋণদান করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু ব্যাংকাররা উপরের চাপে অথবা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের স্বার্থে এমন সব প্রকল্পে ঋণদানের জন্য সুপারিশ করেন, যা কোনোভাবেই লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এসব প্রকল্প এক সময় ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়। একজন ব্যাংকার যদি সততার সঙ্গে ও নির্মোহভাবে প্রকল্প মূল্যায়ন করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন প্রকল্পটি ভবিষ্যতে লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে পারবে কিনা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকাররা নৈতিকতার সঙ্গে আপস করে থাকেন।
খেলাপি ঋণ দুই প্রকার। একশ্রেণির উদ্যোক্তা বা ঋণগ্রহীতা আছেন, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা প্রতিকূলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। যারা প্রকৃত ঋণখেলাপি, তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য সামর্থ্যবান করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না, তারাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাই ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছেন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। সরকার চাইলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যাংক খাতে কারা প্রকৃত ঋণখেলাপি আর কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তা চিহ্নিত করে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কিছুই করা যাবে না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করার সময় তার ক্যাশ ফ্লো সঠিকভাবে যাচাই করা হলে ঋণখেলাপির হার অনেকটাই কমে যাবে। এ ছাড়া ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক দেওয়া হয়, তার সঠিক ভ্যালুয়েশন করতে হবে।
উন্নত দেশগুলোতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বয়কট করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়। কাজেই যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধে কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেন না। আমাদের দেশে এমন অনেক ঋণখেলাপি আছেন, যারা সিআইপির মর্যাদা ভোগ করছেন। আগে নিয়ম ছিল কোনো শিল্পগোষ্ঠীর একটি মাত্র প্রকল্প ঋণখেলাপি হলে অবশিষ্ট প্রকল্পগুলোর অনুকূলে কোনো নতুন ঋণ দেওয়া হবে না। বিগত সরকার বিদায় নেওয়ার আগে এ আইন পরিবর্তন করেছে। এতে বলা হয়, কোনো শিল্পগোষ্ঠীর একটি প্রকল্প ঋণখেলাপি হলেও অবশিষ্ট প্রকল্পগুলোর অনুকূলে ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না।
এদেশের ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমটাই হচ্ছে ব্যাংকভিত্তিক। কাজেই ব্যাংক খাত যদি ভালোভাবে না চলে, তাহলে পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। দেশের অর্থনীতির আকার ও শক্তির তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যক্তি খাতে সর্বশেষ ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দানকালে বলেছিলেন, দেশে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোদন দিলে যে তা ভালো ফল বয়ে আনে না, তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তার অধিকাংশই ভালোভাবে চলছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংক বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় সমর্থন দিয়ে চালানোর কোনো মানে থাকতে পারে না। দেশে কতটি ব্যাংক থাকবে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। বাজারই নির্ধারণ করবে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়েছে, নাকি কম হয়েছে। (অনুলিখন)
লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউিরিটিজ মার্কেটস; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)