সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ফেরদৌস আরা বেগম
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/08/Ferdawus-Ara-begum-67a67d4111d4f.gif)
আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেতে শুরু করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শেষে ৪ থেকে ৫ শতাংশে স্থিত হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার এক সাম্প্রতিক বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। এটি বাস্তবিকই একটি আশার কথা। এর পেছনে এক্সচেঞ্জ রেটের স্থিতিশীলতা ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং সরবরাহজনিত ব্যবস্থা অবদান রাখবে বলে জানানো হয়েছে। সে সময় আগের মতো মানুষ বিশ টাকা দরে আলু এবং শীতকালীন শাকসবজি সস্তায় কিনতে পারবে, এটাও বলা হয়েছে। তবে একথা সত্য, শুধু ব্যাংক খাতের সংস্কার পুরো অর্থনীতিকে ঠিক করতে পারবে না; স্টক মার্কেট, বন্ড মার্কেট, ইন্স্যুরেন্স মার্কেট-সব ক্ষেত্রেই সংস্কার দরকার হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ আপাতত কিছুটা ভরসা পেলেও তারা একান্তভাবে চায়, নিত্যপণ্যের দাম তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসুক। আলু যা প্রান্তিক মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য, তা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। বন্যায় বীজ নষ্ট হওয়ার কারণে আলুর দাম বিগত বছরের তুলনায় একটু আগেই বেড়েছে। তেল, পেঁয়াজ সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী। চালের দাম একইভাবে বেড়েছে। সুখের বিষয়, সবজির দাম কিছুটা সাধ্যের মধ্যে। কারণ শীতের সবজি বাজারে আসতে শুরু করেছে। যা হোক, ইতোমধ্যে সরকার চল্লিশ টাকা কেজি দরে আলু সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে, যা সাধারণ দরিদ্র মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। তবে এর সরবরাহ আরও বাড়াতে হবে। কারণ এগুলো ক্রয়ে মানুষ যেভাবে জীবনবাজি রেখে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে, তা বাস্তবিকই ধারণার অতীত।
সেদিন এক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন শীতের শাকসবজির কথা। বাজারে এর কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দাম তাদের সাধ্যের বাইরে। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন, আগে দুশ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগ ভরে সওদা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন। আর এখন এক হাজার টাকায়ও ব্যাগ ভরে না। জানালেন, প্রতি পঞ্চাশ কেজি চাল তিনি এক মাসের জন্য কেনেন ৩ হাজার ৩৫০ টাকায়, যা আগে ২ হাজার টাকায় কেনা যেত। তাদের রোজগার বাড়ে তো নয়ই, বরং কমেছে। আর অসুখবিসুখ হলে তো উপোস থাকার অবস্থা হয়।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মূল্যস্ফীতি। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই শিরোনাম হয় মূল্যস্ফীতির বিষয়টি, আমরাও ধীরে ধীরে কেমন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি বেশি দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। তবে আমাদের অতি দরকারি খাদ্যতালিকা থেকে একটি একটি করে অতি প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ পড়ছে। একটি পরিবারে হয়তো সপ্তাহে দুডজন ডিম কেনা হতো। তা পর্যায়ক্রমে এক ডজন, এরপর আধা ডজনে চলে আসছে। অলক্ষে পুষ্টির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ভবিষ্যতের অসুস্থ নাগরিকের সংখ্যা নানা উপায়ে আমরাই বাড়িয়ে দিচ্ছি। ইদানীং লক্ষণীয়, অফিস যুবা চাকুরেদের একটি অংশ হয় বিলম্বে অফিসে আসছে অথবা অসুস্থ থাকছে। অফিসেও কিছুটা কম মনোযোগী। অতি মূল্যস্ফীতি তাদের মানসিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্য রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এতে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। প্রথমত, ‘কস্ট অব লিভিং’ বেড়ে যাওয়ার ফলে হার্ডশিপ তৈরি হচ্ছে, মানুষের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। এমনকি মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণও হতে পারে। ফলে এতে স্বাস্থ্য খাতের খরচ বেড়ে যেতে পারে। যে কারণে তারা দীর্ঘদিন হেলথ কেয়ারের বিষয়টিকে চেপে রেখে কঠিন সমস্যায় পড়তে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ইনডেক্সের প্রচলন নেই। তবে ইউএস ব্যুরো অব ইকোনমিক এনালাইসিস বা বিইএ পার্সোনাল কনজাম্পসন এক্সপেন্ডিচার প্রাইস ইনডেক্স বের করে, যা কনজিউমার স্পেনডিং ফর হেলথ কেয়ার বিবেচনা করে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ইনডেক্স নেই, তবে করা হলে এ ব্যাপারে জানা যেতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনোভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এর কারণগুলো একাধিকবার আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর অনেকটা স্বাধীনভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ১১ বার পলিসি রেট বাড়ানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির উচ্চমাত্রা কমানোর সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ বলে ধরা হয়। কিন্তু তারপরও মূল্যস্ফীতি কিছুতেই কমছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ মেডিসিন ভালো ফলাফল দিলেও বাংলাদেশে এ যাবৎ এর কার্যকারিতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। উপরন্তু বেসরকারি খাতের ওপর ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সংকোচন এবং এর ফলস্বরূপ বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা বর্তমান অর্থনীতির বেহাল দশাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের জন্য মনিটারি, ফিসক্যাল এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে সমন্বয়ের দরকার হয়। মনিটারি পলিসি সংকোচনমূলক এবং ফিসক্যাল পলিসি দেরিতে হলেও সরকারি খরচ সংকোচনমূলকই বলা যায়। বাজারে সব পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি আছ, তাও বলা যায় না। তবে সরকার নিত্যপণ্যের শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে এগুলোর দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করেলেও বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি।
মনিটারি টুলসগুলো কাজে আসছে না। কারণ বিপুল পরিমাণে ইনফরমাল ইকোনমির অবস্থান অর্থাৎ পলিসি রেট বাড়িয়ে অর্থনীতিতে মানি সার্কুলেশন কমিয়ে আনার ব্যবস্থা বাংলাদেশে সমভাবে কাজ করবে না। একইসঙ্গে সরবরাহ যদি সঠিক থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তবে সরবরাহ শৃঙ্খল সঠিক রাখার যে দুটি মূল বিষয়-উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান, স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা-দুটোই একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে; উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান অনেকটা অনুমানভিত্তিক, কৃষকের নিজস্ব স্টোরেজ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, সরকারি গুদাম যে পরিমাণে দরকার তা নেই, নেই পরিপূর্ণ মনিটরিং ব্যবস্থা, যা থেকে আগেভাগেই কোন খাদ্য কোন সময়ে ঘাটতি পড়বে তা জানা যাবে। খাদ্যশস্য মধ্যে সরকার সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চাল ও গম। চাল আমদানির ব্যাপারটি নির্ভর করে উৎপাদনের ওপর। ২০২২-২৩ সালে প্রাক্কলিত ও প্রকৃত উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য ছিল ২ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন। আমদানি হয়েছে এক মিলিয়ন টনের কিছু বেশি, অর্থাৎ কিছুটা গ্যাপ রয়েছে, যে কারণে হয়তো চালের দাম বাড়তি। অন্যদিকে গমের আমদানি ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমাদের আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকার বিভিন্ন সময়ে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য কমিটি গঠন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ট্যারিফ কমিশনকে না নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেও তা তেমন কোনো ফল দেয়নি। এ ব্যাপারে টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, বিগত সরকার সম্পদ না বাড়িয়ে টাকা ছাপিয়ে দায়দেনা শোধ করেছে, এর প্রতিক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিরসন করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নেট ফরেইন অ্যাসেট, যা জুন ২০২০-এ ছিল ২.৮৬ লাখ কোটি টাকা, তা জুন ২০২৪-এ এসে দাঁড়িয়েছে ২.৪৭ কোটি টাকায়। অন্যদিকে ডমেস্টিক অ্যাসেট বেড়েছে ১.৬৭ লাখ কোটি টাকা। এ সম্পদ রিয়েল অ্যাসেট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ মুদ্রা ছাপানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা উৎপাদন বা রপ্তানির কাঁচামাল ক্রয়ে ব্যবহার করা হয়নি, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে সাহায্য করেছে।
অন্যদিকে নন-পারফর্মিং লোনের পরিমাণ বেড়েছে; ২০২২-এ যা ছিল মোট ঋণের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সাধারণত ক্ষুদ্র উদোক্তারা ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ পায় না, বড় উদোক্তারাই ঋণখেলাপি হয়েছে। এদের মধ্যে কতটুকু ইচ্ছাকৃত খেলাপি আর কতটুকু প্রকৃত কারণে খেলাপি, তা নির্ধারণ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। মূল্যস্ফীতি সমস্যায় বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে প্রান্তিক মানুষকে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই এ সমস্যা তৈরির জন্য দায়ী নয়।
একই সঙ্গে বেড়েছে ব্রড মানির পরিমাণ। যেমন, ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০২৩-এ এসে এর পরিমাণ হয়েছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, অর্থনীতিতে দুই ধরনের মানি থাকে, একটি হলো ব্রড মানি অন্যটি ন্যারো মানি। ন্যারো মানি হলো কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক প্লাস ডিমান্ড ডিপোজিট। অন্যদিকে ব্রড মানি হলো কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক প্লাস ডিমান্ড ডিপোজিট প্লাস টাইম ডিপোজিট। ব্রড মানি বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতির আরেকটি উপলক্ষ্য হতে পারে। এর অর্থ হলো মানুষের হাতে অর্থ আছে, কিন্তু বাজারে দরকারি জিনিস নেই অর্থাৎ সরবরাহ ঘাটতির কারণে মূল্যস্ফীতি।
সরকার অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের শুল্ক হ্রাস করেছে; যেমন-ডিম, পেঁয়াজ, চাল, তেলের আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য সময়মতো আমদানি করা যায়নি। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। আমদানি করা হবে বললেই সঙ্গে সঙ্গে আমদানি করে ঘাটতি মেটানো সবসময় সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে চাকরি এবং উচ্চ মজুরি পরিবারের আয় বাড়ায় এবং ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করে, সামগ্রিক চাহিদা আরও বৃদ্ধি করে এবং সংস্থাগুলোর জন্য তাদের পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে। যখন এটি একটি বৃহৎসংখ্যক ব্যবসা ও সেক্টরজুড়ে ঘটে, তখন এটি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।
বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঠিক কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে কারণে এর সঠিক প্রতিষেধকও প্রয়োগ করা যায়নি। সরবরাহজনিত মূল্য বলা যায় কিনা জানি না, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি আছে বলে মনে হয়নি, থরে থরে সাজানো রয়েছে সব পণ্য, শুধু কেনা যাচ্ছে না উচ্চমূল্যের কারণে। অন্যদিকে দাম কমেছে যেভাবে বলা হয়, তাও সঠিক নয়। ডিমের দাম একশ আশি টাকা হয়ে যাওয়ার পর একশ ষাট টাকা হলেই তা দাম কমেছে বলে ধরা হয়, কিন্তু সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলো কি না, তা দেখার কেউ নেই। অথচ ডিমের দাম হওয়া উচিত খুব বেশি হলে একশ বিশ টাকা, যা কিছুদিন আগেও ছিল। সম্প্রতি কিছু পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। এটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য সঠিক হোক, আমরা সে ভরসায়ই থাকতে চাই। গভর্নর তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে, পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই নীতিমালা ও ব্যবস্থাপত্র কাজ করবে, যখন একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)