আগামীর সম্ভাবনা তথ্যপ্রযুক্তি খাত
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
রাফেল কবির
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![আগামীর সম্ভাবনা তথ্যপ্রযুক্তি খাত](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/08/Rafel-Kabir-67a67d710610a.gif)
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত আজ এক বিশাল অগ্রযাত্রার সাক্ষী। অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ খাতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে জিডিপিতে এ খাতের অবদান বর্তমানে ১.২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে সফটওয়্যার ও আইটি সেবার বাজার প্রায় ২.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারের অবদান প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৮৪০ মিলিয়ন ডলার। এ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) প্রায় ৪৫০ সদস্য-প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
বেসিসের ২,৬৫০ সদস্য-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২,৩৫০টি প্রতিষ্ঠানই ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের (এসএমই), যা দেশের আইটি খাতের ভিত্তি। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের ফলে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশীয় আইটি কোম্পানিগুলো দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে বছরে বিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যাওয়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মতো দেশে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। বাজার সম্প্রসারণে বেসিস ‘আমেরিকা ডেস্ক’ এবং ‘জাপান ডেস্ক’ কার্যক্রম শুরু করেছে। ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়ার বাজারেও প্রবেশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
ফ্রিল্যান্সিং খাতেও বর্তমানে বাংলাদেশ রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি মানুষের। এতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। পাশাপাশি, দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন। এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে আইটি উদ্যোক্তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং বেসিসের নিরলস প্রচেষ্টা।
তবে এ খাতের সামনে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং নীতিগত প্রতিবন্ধকতা এখনো সমাধানযোগ্য বিষয়। বর্তমানে আইটি খাতে ২ লাখেরও বেশি তরুণ পেশাজীবী কর্মরত, যাদের অধিকাংশই আইসিটি গ্র্যাজুয়েট। প্রতিবছর ২৫ হাজার আইসিটি শিক্ষার্থী পাস করলেও উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদের অভাব এখনো বড় সমস্যা। বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব।
আগামী দশকে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার সিকিউরিটি, বিগ ডাটা ও ব্লকচেইনের মতো ‘নেক্সট জেনারেশন টেকনোলজি’ গ্রহণে প্রস্তুত হচ্ছে। দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য কারিকুলাম সংশোধন, কর সুবিধা বৃদ্ধি এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দেশীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গুরুত্বও বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতির ইতিবাচক প্রভাব দেশের অন্যান্য খাতেও পড়ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও পরিবহণ খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি সেবার মান এবং নাগরিকদের জীবনের মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এজন্য গ্লোবাল আউটসোর্সিং মার্কেটে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং স্থিতিশীল নীতিমালার সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও সরকারি প্রকিউরমেন্টে দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রাধান্য দেওয়া, তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি খাতে নগদ প্রণোদনা ১০ শতাংশে উন্নীত করা এবং এটুআই সম্পর্কিত আইন সংশোধনের দাবিগুলো এ খাতকে আরও গতিশীল করতে পারে।
আমরা এখন এক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের যেসব দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এটি তরুণ প্রজন্মের সংগ্রামের প্রতীক এবং সমগ্র জাতিকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ দিয়েছে। আজকের দিনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তি সমাজে যে পরিবর্তন আনতে পারে, তা তারই প্রতিচ্ছবি। তথ্যপ্রযুক্তি শুধু এক নতুন শিল্পক্ষেত্র নয়, এটি দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি বাংলাদেশকে একটি বিশ্বমানের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে সহায়তা করতে পারে। আজকের তরুণরা প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও উদ্যমের মাধ্যমে এমন এক সাফল্য অর্জন করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করবে। বাংলাদেশে এখন হাজার হাজার তরুণ উদ্ভাবক, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা রয়েছে, যারা বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করছে। তারা শুধু প্রযুক্তির বিকাশে কাজ করছে না, বরং নতুন ভাবনা ও চিন্তার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের ফলে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবহণ এবং অন্যান্য খাতে উদ্ভাবনী সমাধান আসছে। উদাহরণস্বরূপ, দেশে ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের বিস্তার, স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিনের সুবিধা, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার-এসব তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফল। তরুণরা যখন নিজেদের আইডিয়া ও উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে, তখন তারা শুধু নিজেদের জন্য কাজ করে না, বরং বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ায়।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বিশেষ দিক হলো এর বিশাল তরুণ জনবল। দেশটি বিশ্বের অন্যতম তরুণ জনগণের দেশ হিসাবে পরিচিত। এ তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য এক আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। দেশে প্রযুক্তির বিকাশে তরুণদের এই অংশগ্রহণ তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে এবং দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) মতো প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও তরুণদের উৎসাহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বেসিস বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছে, যাতে তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। এটি শুধু উদ্যোক্তা সৃষ্টি নয়, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে সাহায্য করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাফল্য শুধু দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করবে না, বরং বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। আমাদের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাতে আরও বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। এ অগ্রযাত্রায় তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং বেসিসের মতো সংগঠনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে, যা সম্ভব হবে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বেই। এটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে, যেখানে প্রযুক্তির সহায়তায় সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বেসিস সহায়ক কমিটি