Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

কৃষিকাজে প্রযুক্তি ও পুঁজির গুরুত্ব

Icon

মোঃ ফজলুল কাদের

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) একটা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্যদূরীকরণের একটা পরিকল্পনা ছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকে প্রায় ৩৩-৩৪ বছর পার করে আমাদের বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের জীবনের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হয়েছে।

১৯৯০ সালের কৃষির দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তখন আমাদের কৃষি ছিল সাবসিসটেন্স ফরমিং। যেটাকে আমরা বলি-খোরপোষের কৃষি। যেখানে কৃষক মূলত তার খোরাকিগুলো উঠে যাওয়ার পর সেটা জমিয়ে রেখে যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে, সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে সে তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করত। এক সময় অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ধারণা ছিল, ছোট ছোট কৃষি খামারগুলো দক্ষ হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে-ছোট ছোট যে ফার্মগুলো ছিল, সেগুলো খুবই দক্ষ ছিল। এ ফার্মগুলো এফিসিয়েন্টলি করা হলেও সেগুলো মূলত খোরপোষের কৃষিই ছিল। নতুন নতুন টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন, অর্থায়ন, ইতিবাচক অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশে আমরা এখন প্রবেশ করেছি কমার্শিয়াল কৃষি জগতে এবং আমরা দেখেছি ছোট ছোট ফার্মগুলো; কিন্তু এখন কমার্শিয়াললি সাসটেইনেবল হতে পারে। পিকেএসএফের কর্মকাণ্ডগুলো কিন্তু বিবর্তিত হতে থাকে। মাঠ পর্যায়ের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে একটু ভবিষ্যতের কথাও আমরা ভাবছি। সেটা চিন্তা করে কৃষিকে টেকসই করাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আর এজন্য আমরা যেটা করছি-আমরা দুশ’রও বেশি ভ্যালু চেইনে ইন্টারভেন করেছি। সাধারণভাবে কৃষি বললে আমাদের শুধু কৃষকের কথাই মনে হয়; কিন্তু আমি যদি একটা এগ্রিকালচারাল ইকোসিস্টেমের কথা চিন্তা করি, সেখানে কিন্তু কৃষক একজন অন্যতম নায়ক, এখানে আরও অনেক নায়ক আছেন। পেছনে বিজ্ঞানীরা আছেন, ব্যবসায়ীরা আছেন, সম্প্রসারণের সঙ্গে যারা কাজ করেন তারা আছেন,

ভালো বীজ উৎপাদক যারা করেন তারাও আছেন, কৃষির উৎপাদন আছে। এর বাইরে আরেকটা বড় নায়ক আছে-সেটা আমাদের মাটি ও প্রকৃতি। এর পাশাপাশি ফরওয়ার্ড লিঙ্কে, অর্থাৎ মার্কেটিং চ্যানেলে রিটেইলিং পর্যন্ত সবাই এ ইকোসিস্টেমের অংশ।

আমরা ভ্যালু চেইনে ইন্টারভেন করি, যাতে এ পুরো ইকোসিস্টেমের কোথাও যদি কোনো বাধা থাকে, যার কারণে পুরো ইকোসিস্টেমটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অর্থাৎ সঠিকভাবে এ চেইনটা চলছে না। আমরা সেই বাধাগুলোকে দূর করে থাকি। মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ সেক্টর বা কৃষি মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ সেক্টর নিয়ে সামগ্রিকভাবে যদি বলি, আমরা একটা লো লেভেল টেকনোলজির ফাঁদে পড়ে আছি। আমরা এখানে টেকনোলজি ট্রান্সফারের জন্য কাজ করছি। কৃষকের জন্য অ্যাফোর্ডেবল টেকনোলজির ব্যবস্থা করছি, অর্থায়ন করছি এবং এমনভাবে ফাইন্যান্সটা করছি যেন এটা টেকসই হয়, অর্থাৎ এটা অনুদাননির্ভর কোনো কিছু যেন না হয়।

মার্কেটিং ডেভেলপ করার জন্য আমরা কাজ করছি। একটা উদাহরণ দিলে জিনিসটা আরও পরিষ্কার হবে-মাঠ পর্যায়ে আমরা এখন ছোট ছোট মিট প্রসেসিং প্লান্ট করছি। এ মিট প্রসেসিং প্লান্টগুলো বাণিজ্যিকভাবে খুব সফলতার সঙ্গে চলছে। এখানে লোকরা ঋণ নিয়ে নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করে কমার্শিয়াললি চালাচ্ছে। নেটিভ চিকেন পালন হচ্ছে। এগুলোকে ড্রেসিং প্যাকেজিংসহ প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য আমরা অনেক আইএসও সার্টিফিকেট নিয়েছি। যেটি এ পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। আমাদের অনেক কৃষি উদ্যোক্তারা বিএসটিআই-এর অনুমোদন নেওয়া শুরু করেছে। এর বাইরে ডেইরি সেক্টরে আমরা অনেক ধরনের ডাইভারসিফাই করেছি। লাবান থেকে শুরু করে চিজ নানা ধরনের মাখন, প্রোটিন ড্রিংস বা হোয়ে প্রোটিন নামের প্রোটিন ড্রিংস। যেটা বাংলাদেশে প্রথম প্রচলন হয়েছে। ডেইরি প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈচিত্র্যের কারণে ডিমান্ড ফর মিল্ক বাড়বে এবং ডিমান্ড ফর মিল্ক বাড়লে ডেইরি সেক্টরে মানুষ বেশি বেশি ইনভেস্টের আগ্রহ দেখাবে। আমরা চাই ডেইরি শিল্পের লোকরা যেন শুধু দুধটুকুই বিক্রি না করে, দুধের সঙ্গে সঙ্গে দুধের তৈরি প্রোডাক্ট যেমন- মাখন, ঘি, চিজ বা আরও বিভিন্ন ধরনের দুধের তৈরি জিনিস বিক্রি করে। এরপর সরিষার তেলের কথা বলি, কোল্ড প্রেস মাস্টার্ড অয়েলের বিশ্বব্যাপী একটা চাহিদা আছে। এখন বাংলাদেশের অনেকেরই সেই পারচেজিং পাওয়ার রয়েছে। আমরা অনেক কৃষি উদ্যোক্তাদের দিয়ে এ ধরনের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছি এবং আমরা তাদের অর্থায়ন ও পরামর্শ দিচ্ছি। তারা নিজেদের পুঁজি খাটিয়ে এ ধরনের উনিশটির মতো ফ্যাক্টরি করেছে। এর পাশাপাশি সানফ্লাওয়ার অয়েলের জন্য অনেক ফ্যাক্টরি হচ্ছে যেটা আগে ঘানিতে হতো।

এরপর মহিষের দুধ নিয়ে কাজ করছি। মহিষের দুধ থেকে যে ধরনের ঘি হয়, সেটা কিন্তু গাওয়া ঘি এর মতো নয়। পাশাপাশি মহিষের দুধ থেকে কটেজ চিজ হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা ‘র’ কৃষি পণ্যের বিক্রিকে নিরুৎসাহিত করছি। কারণ ‘র’ বিক্রির মাধ্যমে আমরা কখনোই লাভবান হতে পারব না। তাই ‘র’ বিক্রি না করে এটার সঙ্গে যত বেশি ভ্যালু অ্যাড করা যায়, তত ভালো। বাংলাদেশে আমরা এনেছি জি-নাইন কলা। জি-নাইন কলা খুবই ভালো কলা। বিশ্ববাজারে এ কালার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো এটার সাইজ-এটা একটা নির্দিষ্ট সাইজের হয় এবং সে সাইজে প্যাকেজিং করা খুব সহজ।

একই সঙ্গে এমডি টু আনারস আমরা বাংলাদেশে এনেছি এবং অলরেডি প্রায় এক কোটির বেশি আনারসের অর্ডার আমরা পেয়েছি। এর সবই এগ্রো-ইকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে হচ্ছে।

ডিমের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে আমাদের ১২ হাজারের মতো লোক বাড়িতেই কমার্শিয়াললি দেশি মুরগি পালন করছে। তাই শিগ্গির দেশি মুরগির ডিমের সাপ্লাই আরও বেশি দৃশ্যমান হবে। পাহাড়ি মুরগিও অনেক জায়গায় চাষ হচ্ছে। হাঁসের ক্ষেত্রে পানি ছাড়া যে হাঁস, যেগুলোকে প্যাকিং হাঁস বলে, সেগুলোকে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রমোট করছি। যেগুলো অনেক বড় হয়, ডিম পাড়ে। তাই এগুলো দিয়ে একইসঙ্গে ডিম এবং মাংশের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। আর বেশিরভাগ হাওড় অঞ্চলই টিপিকাল মাইক্রো ফাইন্যান্সিং প্রোগ্রামের আওতায় আছে। হাওড়ে চরে বেড়ানো হাঁসগুলোকে বলে ফ্রি-রেঞ্জ হাঁস। এগুলোর আলাদা একটা বাজার আছে। আমরা এর ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে পারছি না। এগুলো কিন্তু নরমাল বাণিজ্যিক বা ফার্মের মুরগির মতো নয়। ফ্রি-রেঞ্জ হাঁস বিশ্ববাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। আমরা হাওড়ের এ ফ্রি-রেঞ্জ হাঁসগুলোর বিপণনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, যাতে করে এগুলোর ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হয় এবং আমরা কৃষিপণ্যের ব্যান্ডগুলো করার জন্য খুব সফিস্টিকেটেড কিছু ইন্টারভেনশন করছি।

প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য মেকানাইজেশন লাগবে এবং সেই মেকানাইজেশনের জন্য উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে এবং সরকারের তরফ থেকে নানা সাপোর্ট করছে। কোভিডের সময় সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও হারভেস্টার মেশিন নিয়ে আসার জন্য অনেক অর্থায়ন করেছি। আমার যেটা ধারণা হয়েছে, আমাদের হার্ভেস্টার বা টিলার মেশিনের ক্ষেত্রে আরও ছোট ছোট সল্যুশন লাগবে এবং আশার কথা হচ্ছে, এ জাতীয় সল্যুশন কিন্তু পৃথিবীতে আছে। বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, ঢাকাসহ আরও কিছু অঞ্চলে আমাদের যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা গড়ে উঠেছে, সেই প্রেক্ষাপটে আমরা এ প্রযুক্তিগুলো এনে আমাদের দেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারব। আমার ধারণা, আগামী দেড়-দুই বছরের মধ্যে ছোট ছোট এ প্রযুক্তিগুলো আমাদের দেশে চলে আসবে এবং এ সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।

লেখক : অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক

পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম