কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্র
এম এম আকাশ
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এ লেখার বিষয়বস্তু এত বিষয় থাকতে এখন কেন প্রাসঙ্গিক মনে হলো সেই প্রশ্নটি পাঠক রচনাটি পড়ার আগেই করতে পারেন। এর কারণ হচ্ছে বিএনপিসহ কতিপয় বামদল এখন ‘একদলীয়’ শাসনের বিপদ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করতে শুরু করছেন। সেটি করতে গিয়ে কোনো কোনো বামেরা বাকশালকেও আলোচনায় টেনে এনেছেন। সেটি নিয়ে একটি গভীর আলোচনা হওয়া উচিত, কারণ গণতন্ত্রহীন উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি অগ্রসর হয়, তাহলে এবার তা ‘বাকশাল’-এর দর্শন অনুসারে হবে না বলেই সবার ধারণা। বরং তা সর্বোচ্চ ‘ভালো’ হলে হতে পারে ‘সামরিক শাসক পার্ক চুং হীর দক্ষিণ কোরীয় উন্নয়ন মডেল’ বা ‘লি-কুয়ান ইউর সিঙ্গাপুরীয় শক্ত রাষ্ট্রের উন্নয়ন মডেল’ অথবা এ রকম হওয়ার কিছু ‘ব্যর্থ প্রচেষ্টা’ মাত্র আমরা দেখব।
একাডেমিক মহলের এ ধরনের আকাশকুসুম ভাবনা ও গুঞ্জন নিয়ে ভাবতে ভাবতে মার্কসের একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে গেল। প্রগতিশীল ইতিহাস পাঠকের কাছে উদ্ধৃতিটি সুপরিচিত। মার্কস তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Eighteenth Burmmaire of Louise Bonaparte’ শুরু করেছিলেন সেই উদ্ধৃতিটি দিয়ে। উদ্ধৃত প্রথম বাক্যটি ছিল-
‘Hegel remarks somewhere that all facts and personages of great importance in world history occur, as it were, twice. He forgot to add: the first time as tragedy, the second as farce.’ [ Marx, Engels, Selected Works, vol-one, progress publishers, fifth printing, 1983, p-398]
বাংলায় এর অর্থ
‘হেগেল কোনো এক জায়গায় বলেছিলেন যে, যাবতীয় সত্য ঘটনা ও ব্যক্তি যা কিছু ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্বে যেন দুবার অনুষ্ঠিত হয়। হেগেল বলতে ভুলে গিয়েছিলেন যে, প্রথমবার তা ঘটে ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক হিসাবে, আর দ্বিতীয়বার তা ফিরে আসে প্রহসন হিসাবে।’ [নিজস্ব বঙ্গানুবাদ]
‘বাকশালকে’ আমার মনে হয় অনুরূপ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মতো, যা প্রথমে ঘটেছিল একটি ‘বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি’ হিসাবে এবং এখন আবার যদি কেউ তা ঘটায় বা ঘটাতে চান, তাহলে তা ঘটবে নিতান্তই একটি হাস্যকর প্রহসনজাতীয় ঘটনা হিসাবে।
আগে বাকশালের চেষ্টাটা ট্র্যাজেডি হিসাবে দেখা সম্ভব হলেও এখন সে চেষ্টাটা হবে নিতান্তই একটি হাস্যকর প্রহসন। তবে তার আগে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার ‘বাকশাল’ জিনিসটা আসলে কী? আক্ষরিকভাবে দেখলে বলা যায় ‘বাকশাল’ একটি ‘সংক্ষিপ্ত নাম’ (Abbreviation)-এর পূর্ণ শব্দটি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।’ আসলে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীন বাংলাদেশের তদানীন্তন একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের Brain child ছিল ‘বাকশাল’ নামক ‘একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা’। ‘গণতান্ত্রিক বহুদলীয় পথে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। [দেখুন দৈনিক সমকালে প্রকাশিত বিনায়ক সেন লিখিত ‘বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য’ ধারাবাহিক রচনা অথবা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ লিখিত, ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র : একটি রূপরেখা’ নামক গ্রন্থটি। অতিসম্প্রতি বিআইডিএস, বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা, বার্ষিক সংখ্যা, ২০২৩ জার্নালে এ লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে।]
বাকশালকে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসাবে অভিহিত করেন। বাকশালের উল্লেখযোগ্য ও অভিনব প্রধান তিনটি কর্মসূচি ছিল
১. দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে-যার নাম হবে কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ। মনে হয় ধারণা করা হয়েছিল যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকরাই হবেন এ দলের মালিক। ওই একদলীয় শাসনকে বঙ্গবন্ধু নামকরণ করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। শোষণহীন বাংলাদেশে শোষকদের অস্তিত্বের যেমন কোনো প্রয়োজন নেই তেমনি তার ব্যাখ্যা অনুসারে শোষকদের কোনো দলও বাংলাদেশে থাকার দরকার নেই। আর সব শোষিত তো একটি দলেই থাকবেন। সুতরাং একটি দলই থাকবে। বাস্তবতা বিচারে তার এ ধারণায় প্রধান ভুলটি তখন ছিল এ জায়গায় যে ‘বাকশাল’-এ সচেতন শ্রমিক-কৃষকের সংখ্যা ছিল নগণ্য সুতরাং সেটা প্রকৃতপক্ষে ছিল প্রধানত অকৃষক ও অশ্রমিক, শোষক-শোষিতদের মিশ্রিত একটি মাল্টিক্লাস দল। বিপুলসংখ্যক কৃষক শ্রমিকরা তখনো সেই দলে হয়তো ছিল-কিন্তু ছিল নীরব ও অসচেতন সমর্থক অথবা অগত্যা অনুসারী হিসাবে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কিছু সংশয়-কিছুটা হতাশা-কিছু প্রত্যাশা নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। এ ধরনের মিশ্র শোষক-শোষিতের বিশাল দলের চরিত্র নির্ভর করে কারা এ দলের নেতৃত্বে বা শীর্ষে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন তার ওপর। তাই বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত ‘বাকশাল’ জন্মলগ্নে একটি কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নদল হিসাবেই যাত্রা শুরু করে এবং স্বপ্ন জন্মের অল্পদিন পরই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন দলটি আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করে।
যদিও এরপর আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র একটি অংশ জনাব আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ‘বাকশাল’ টিকিয়ে রাখার শেষ একটি চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষাবধি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যখন বাকশাল বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করে বহুদলীয় রাজনৈতিক পন্থায় আবার ফিরে গেলেন তখন বাকশাল সমর্থকরাও আব্দুর রাজ্জাকসহ আবার আওয়ামী লীগেই ফিরে যান বা যেতে বাধ্য হন। এভাবেই বাকশাল ট্র্যাজেডির করুণ পরিসমাপ্তি হয়।
২. বাকশালের ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মৌলিক পরিবর্তনের কর্মসূচি ছিল-প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও নির্বাচিত জেলা প্রশাসকের অধীনে বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এক কথায় আমলাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভেঙে দিয়ে তৃণমূলে কিকেন্দ্রীভূত নির্বাচিত প্রশাসনিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। শত বছরের ঔপনেবেশিক ঘুণে ধরা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এটি ছিল একটি মৌলিক যুদ্ধ ঘোষণা। যদিও এ ঘোষণাটিও ছিল স্বপ্নের মতো। জেলায় জেলায় প্রথমবারের মতো মনোনীত কিছু গভর্নরের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র। সে সময় সেটুকুতেই অবশ্য কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের ঘুম হয়তো প্রথমবারের মতো হারাম হয়ে গিয়েছিল! তারা দ্রুতই এর বিরুদ্ধে ভেতর থেকে অন্তর্ঘাত শুরু করে দেন। এখন অবশ্য তাদের নিরংকুশ কর্তৃত্ব আগের চেয়ে প্রবলতর হয়েছে!
৩. সর্বশেষ কর্মসূচিটি ছিল কৃষিব্যবস্থার আমূল সংস্কারের কর্মসূচি। কৃষি জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা বাতিল না করে যৌথ চাষের নিয়ম চালু করা হয়। জমির আইল উঠিয়ে দিয়ে জমি একত্র করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই যৌথ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বাজারের পরিবর্তে রাষ্ট্র থেকে বিকেন্দ্রীভূত নির্বাচিত প্রশাসন বা সমবায় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংগ্রহ বিতরণ ও বণ্টনের নিয়ম ঘোষণা করা হয়। উৎপাদন শেষে ফসল বণ্টনের ক্ষেত্রে তেভাগা পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বলা হয়। তাতে একভাগ জমির মালিকদের মালিকানাধীন জমির অনুপাতে বণ্টিত হবে, একভাগ শ্রমদাতাদের মধ্যে শ্রমের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী বণ্টন হবে এবং সর্বশেষ ভাগটি উপকরণ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের হাতে প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ পরিকল্পিত, কৃষি উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক রূপের বিষয়টি নিয়ে তখন নানা Experiment জল্পনা-কল্পনা চলছিল। কুমিল্লার বার্ডে বা ময়মনসিংহের ফুলপুরে কমিউনিস্টপন্থি কৃষি অর্থনীতিবিদরা ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে এসব গবেষণা নিবিড়ভাবে পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু এগুলোও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীল-নকশা রূপে বা বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে থাকতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধুর শত্রুরা মেরে ফেলে। ফলে বাকশাল কৃষি কর্মসূচিটি টেক-অফ করার আগেই মুখ থুবড়ে রানওয়েতে পড়ে যায়। এটাকেও আমরা বলছি ইতিহাসের ট্র্যাজেডি। যদিও কেউ বলতে পারেন, এখনো কৃষিতে বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভর্তুকি দিয়ে কৃষি উপকরণ কৃষকদের দিচ্ছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোটি কিন্তু এখন উৎপাদক চাষিদের কোনো সমবায় নয়, ফলে এসব সুবিধা প্রান্তিক ও গরিব বর্গা চাষিদের হাতে খুব কমই পৌঁছাচ্ছে।
তাই বাকশাল প্রস্তাবিত অতীত ইতিবাচক সংস্কারের কোনো কিছুই বর্তমানে বাস্তবে নেই। তাই বাকশাল টিকে থাকলে কি হোত-এ নিয়ে আমরা যত তর্কই করি না কেন-তা আজ বৃথা। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, একে আমাদের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি হিসাবেই দেখতে হবে এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে হবে। বস্তুত প্রথমে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিকভাবেই সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তখন চরম বামপন্থি, চরম ডানপন্থি ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সশস্ত্রভাবে তাকে সন্ত্রাসী প্রতি আক্রমণ শুরু করেছিল। বাকশাল গঠনের আগেই জাসদ, সর্বহারা পার্টি, মাওবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড দলগুলো ও স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা সরকারকে অগণতান্ত্রিক সশস্ত্র পন্থায় উৎখাতের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ঈদের জামাতেও তখন গুলিবর্ষণে দ্বিধা করা হয়নি। বাকশাল গঠনের আগে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গীয় বক্তৃতায় তিনি এসব ঘটনার কিছু বিবরণ উল্লেখ করেছিলেন।
কেউ প্রশ্ন রাখতে পারেন বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র থেকে অগণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষায় কি অন্য কোনো গোপন একনায়কত্বের অশুভ উদ্দেশ্য ছিল? তখন আমরা যারা ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী ছিলাম, আমাদের তা মনে হয় নাই, যদিও একদলীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে আমরা তখনো সঠিক মনে করি নাই, এখনো মনে করি না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য নয় বরং তা বিকেন্দ্রীভূত করার জন্যই বাকশালের কর্মসূচিগুলোর কথা ভেবেছিলেন। দ্বিতীয়ত তিনি বুর্জোয়া শিল্পপতিদের ক্ষমতা আগেই শিল্প খাতে খর্ব করেছিলেন-যদিও জাতীয়করণ শিল্পের পরিচালনায় ইপ্সিত সফলতা আসেনি। একই সঙ্গে লক্ষ্যণীয় যে, তখন পর্যন্ত মধ্যবিত্ত ও উদ্বৃত্ত কৃষকের দল তদানীন্তন আওয়ামী লীগের পক্ষে [এ ধরনের দলকে কালেস্কির তথ্যানুসারে বলা হয়, ‘Intermediate Regime’ রেহমান সোবহান ও মোজাফ্ফর আহমদ, ‘PE in an an Intermediate Regime’, BIDS, 1980, দ্রঃ’] ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কৃষিতে কিছু করা সম্ভব হয়নি। তদানীন্তন পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে ৫ একর সিলিং ও পুনর্বণ্টনমূলক ভূসিসংস্কার প্রস্তাব বা এমনকি শুধু ১০০ বিঘা সিলিং প্রস্তাবও তখন আওয়ামী লীগ এমপিরা সরাসরি গ্রহণ করেনি। বঙ্গবন্ধু সংসদে এ ধরনের প্রস্তাব নেওয়ার পর উত্তরবঙ্গের জোতদার এমপিদের চাপের কাছে নিজেও নতি স্বীকার করেছিলেন এবং পরিবারের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। ফলে ১০০ বিঘা সিলিং আইনটি প্রহসনে পরিণত হয়েছিল।
এর এক বছর পর ১৯৭৫ সালে তার শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু কৃষি খাতেও একটি অভিনব উপায়ে শ্রমজীবী কৃষকদের ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিলেন যার বর্ণনা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। তিনি কেন্দ্রে একটি দল বানালেও তাতে সব দলকেই [স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া] স্থান দিয়েছিলেন এবং সেই সবার গণতন্ত্রকে তৃণমূলে বেশি সক্রিয় ও বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন। আকাঙ্ক্ষা হিসাবে এগুলো সবই ছিল কিছুটা অভিনব এবং নিছক ভোটের বা নির্বাচনি গণতন্ত্রের পরিসীমা ছাড়িয়ে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রাভিমুখী।
কিন্তু বাকশাল ব্যর্থ হলো কেন?
বাকশাল আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করেছিল, কারণ বাকশালের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল বাকশালের হত্যাকারীরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারাই বাকশালের কোটর থেকে বের হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন।
বাকশালের সমর্থক সেজে তার ভেতরেই ঘাপটি মেরে ছিল খন্দকার মোশতাক, শাহ্ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ বাকশালবিরোধী শক্তি। ছিল জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের, মাহবুব আলম চাষী প্রমুখ সামরিক-বেসামরিক আমলাবৃন্দ। ছিলেন ছদ্মবেশী আমলা ড. আব্দুস সাত্তার যিনি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারিয়েটে সদস্য হয়েছিলেন এবং বাকশালের পক্ষে অন্যতম স্তাবক ছিলেন [দেখুন রেহমান সোবহানের স্মৃতি কথ- ‘Untranquil recollections’, Sage, 2021, p-303]। অথচ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মোশতাকের সেক্রেটারি হিসাবে তিনিই নিয়োগ পান এবং প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের দুরাবস্থার ওপর তথাকথিত শ্বেতপত্র (white paper). এ রকম বিশ্বাসঘাতক পরিবৃত হয়ে কিছু যে করা যায় না, এটি বর্তমানেও মনে রাখা জরুরি।
অন্যদিকে সে সময় বাকশালের বিপ্লবী সংস্কার কর্মসূচিগুলোকে যারা সত্যিই কার্যকরী করতে চাচ্ছিলেন সেই গঠনমূলক বাম শক্তি তখন দ্বিধায় পড়ে যায়। তখন যে প্রস্তাব নিজেদের মধ্যে গোপনে তারা গ্রহণ করেছিলেন, তাতে তারা বলেছিলেন যে, ‘বাকশাল’-এর ভেতরে গোপনে থেকে একটি স্বাধীন গ্রুপ হিসাবে তারা চেষ্টা করবেন To make best out of the worst. অর্থাৎ তারা অগত্যা বাকশালে যোগ দিয়েই বাকশালকে যথাসম্ভব শুদ্ধ ও ঠিক করার চেষ্টা চালাতে চেয়েছিলেন। পাঁড় দক্ষিণপন্থি ও উগ্র বামপন্থিরাও সে ধরনের নিজ নিজ পরিপ্রেক্ষিত থেকেই তখন বাকশালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। বাকশালের ভেতরে এ দ্বন্দ্বের কী পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি হতো তা নিয়ে এখন পর্যন্ত পণ্ডিতদের মধ্যে প্রায় সমান সমান পক্ষে-বিপক্ষে মত বিদ্যমান।
পরিকল্পনা কমিশনের মূল পরিকল্পকরা, কোনো কোনো একাডেমিশিয়ান [প্রফেসর রাজ্জাক, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর রওনাক জাহান, প্রমুখ উল্লেখযোগ্য] ও অন্যান্য অনেক স্বাধীনচেতা লোকই তখন বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত আস্থা থাকলেও বাকশালে যোগ না দিয়ে বিদেশে বা অন্যত্র অবস্থান নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাই তখন একদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত অন্যদিকে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। তখন তার একটি প্রিয় সংগীত ছিল, ‘যদি তাঁর ডাক শুনে কেউ নাই আসে তবে একলা চল রে।’ [দেখুন ইউপিএল এম. এম. আকাশ বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন, ২০২২, পৃ. ৭১]
বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু তার বাম বন্ধুদের সম্পর্কে অভিযোগ এনেছিলেন যে, তারা চলেন আকাশে বা বিমানে আর তিনি চলেন মাটিতে-বাকশাল গঠনের পর তার সেই পরীক্ষিত কমিউনিস্ট বাম বন্ধুরাই তার বিরুদ্ধে গোপনে বলতে শুরু করলেন যে ‘বঙ্গবন্ধুই চলেন আকাশে ও বিমানে-কমিউনিস্টরা চলতে চান মাটিতে।’ তবে এর পরও কমিউনিস্টরা বিশেষ করে মস্কোপন্থিরা অনেকেই সেই দুঃসময়ে তাকে একলা ফেলে চলে যাননি। প্র্রতিকূল হলেও তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টি তার ওপরই শেষ বাজিটা রেখেছিল।
এরপরও বলতে দ্বিধা নেই যে, বাকশালের প্রগতিশীল আর্থ-সামাজিক কর্মসূচিগুলোর আধার (Content) নিয়ে আসলে খুব বেশি বিতর্ক নেই। আজও বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন এবং শ্রমজীবীদের জন্য ইতিবাচক সুযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষিতে সুলভে কৃষি উপকরণ প্রদান ও ন্যূনতম ভূমি সংস্কার বা বর্গা স্বত্বের তেভাগা সংস্কারের দরকার। এমনকি সিঙ্গাপুর-তাইওয়ান-দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সাবেক ঔপনিবেশিক বা Post Colonial দেশগুলোতে পুঁজিবাদী পথে কিছুটা যে সাফল্য সাধিত হয়েছে তাতেও সেখানে যেসব কঠোর সুশাসন ও সংস্কারের কাজ তাদের কোনো না কোনো সময়ে করতেই হয়েছে সেগুলোও কিছুটা একই রকম রেজিমেন্টাল কর্মসূচি বটে! আজ তাই বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক গণমুখী রাজনৈতিক শক্তি মাত্রেই স্বীকার করেন কৃষি সংস্কার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকীকরণের প্রয়োজনের কথা। তবে বাকশালের অগণতান্ত্রিক একদলীয় কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের দিকটি নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি ও সন্দেহ রয়েছে। সেদিকটা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ অর্থনৈতিক কর্মসূচিটি ও গণতান্ত্রিকভাবে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ কোনো না কোনোভাবে আমাদের দেশে আজও প্রাসঙ্গিক সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে তাকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ বলবেন না ‘বিপ্লবী গণতন্ত্র’ বলবেন না ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলবেন তা নিয়ে বোদ্ধাদের মধ্যে শব্দ পছন্দের তারতম্য ও তর্কবিতর্ক রয়েছে।
বর্তমানে অবশ্য সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। এখন বঙ্গবন্ধুও নেই, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগও নেই। বিদ্যমান আওয়ামী লীগে শুধু যে কৃষক-শ্রমিকের আধিপত্য নেই তা নয়, দলটি তার Intermediate Regime চরিত্রও বজায় রাখতে পারেনি, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আজ মধ্যবিত্তদের দিকে না ঝুঁকে দলটি বর্তমানে শোষক উচ্চবিত্ত তথা ধনী শিল্পপতি এবং ধনী আমলাদের সঙ্গে আপস করেছে এবং তাদের আধিপত্যে পরিচালিত হতে শুরু করেছে। এমনকি ‘জাতীয় নির্বাচনে’ থ্রি-এম [ 3M = Money + Muscle + Manipulation] এর ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করছে। জনগণের থেকে দলটি তাই ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে হতে এখন Fair নির্বাচনে তার জয়লাভ সম্ভব বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন না। যদিও এর বিপরীতে বিএনপি-জামায়াতের ধর্মভিত্তিক ও ভারতবিরোধী শক্তিটিরও শ্রেণিভিত্তিক একই রকম বলেই মনে হয়। ফলে একটি বিকল্পহীন শূন্যতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অগ্রসর হচ্ছে।
এ অবস্থায় বামপন্থিদের মধ্যে কেউ কেউ আবারও যদি দাবি করেন আগের মতোই বর্তমান আওয়ামী লীগকে দিয়েই তারা ‘বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের’ কর্মসূচিগুলোকে আবার কার্যকরী করতে পারবেন, তাহলে সে চেষ্টার পরিণতি আজ শুধু ট্র্যাজেডি হবে না, হবে একটি হাস্যকর প্রহসন বা ‘Farce’। বর্তমান আওয়ামী লীগ যেসব ব্যবসায়ী শ্রেণি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বা পরিবেষ্টিত হয়ে দেশ চালাচ্ছে, আদর্শ হিসাবে যেভাবে মুক্তবাজারকে মোটামুটি গ্রহণ করে নিয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর অন্য জীবনাদর্শগুলো (ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র) বজায় রাখাও তাদের পক্ষে ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৭২-এর মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের মতো সাংবিধানিক ক্ষমতা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের এ মুহূর্তে থাকলেও সে দিকে তাদের পক্ষে কোনোদিন অগ্রসর হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। নতুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নামকে সহজেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু আত্মাকে গ্রহণ করার সক্ষমতা হারিয়েছে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ