পরমতসহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সমাজে বসবাসকারী সব মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিশ্বস্বীকৃত। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করার আচরণের অপর নাম পরমতসহিষ্ণুতা। পবিত্র ইসলামসহ সব ধর্মমতে, কারও কথা, কাজ বা ব্যবহারে ক্রোধান্বিত বা প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে ধৈর্য-সংযম-সহনশীলতার সঙ্গে নিজ নিজ কর্তব্য পালন প্রত্যেক সভ্য নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। একইসঙ্গে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করাও অপরিহার্য। ইসলাম ধর্ম মানবিক সম্পর্কোন্নয়ন, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নির্দেশনা দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়াল ইরশাদ করেছেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়, তুমি যা উত্তম তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করো; ফলে তোমার ও যার মধ্যে চরম শত্রুতা, সে তোমার পরম বন্ধুতে পরিণত হবে (সূরা হা-মীম সেজদাহ, আয়াত-৩৪)। আমাদের প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল পরমতসহিষ্ণুতা। ইসলামের খলিফাদেরও অন্যের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা সুরক্ষায় পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। যে সমাজে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা যত বেশি, সে সমাজে অপরাধপ্রবণতা তত কম। এটি গণতন্ত্রের অন্যতম নিয়ামক হিসাবে প্রতিভাত।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ; অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা তথা চিন্তা, বাক, সংগঠন করা, ভোট প্রদান, দল গঠন, স্বেচ্ছায় নির্বাচন গ্রহণ-বর্জনসহ অভিযোগ উত্থাপন ইত্যাদির স্বাধীনতা। সার্বিকভাবে জীবনধারণ, পরিবার গঠন, নিরাপত্তা, আইনের আশ্রয়, স্বাধীন মতামত প্রকাশ, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধিতার অধিকার-সব কিছুকেই এর অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই গণতন্ত্র শক্তি ও বিকাশ লাভ করে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে নির্ভরযোগ্য সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। গণতান্ত্রিক পাঠ্যক্রমের মুখ্য শিক্ষাই হচ্ছে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে যৌক্তিকভাবে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন। ভল্টেয়ার বলেছেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব।’
গণতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য শুধু জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়; শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য। বস্তুত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চিন্তা মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে সমাজদর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়ে মানুষের মানসিক-মানবিক শক্তিকে একীভূত করেছে। এরই যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণে; যা মানুষকে পার্থিব জগৎ ও পরিবেশের অপরিসীম সৌন্দর্য-আনন্দকে উপলব্ধি করার ক্ষমতায় অত্যুজ্জ্বল করেছে। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যথাযথ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির যৌক্তিক পরিবর্তনের ইতিবাচক রূপই সংস্কার আন্দোলনকে গতিশীল করে আসছে।
বিশ্বায়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই গণতন্ত্রকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেছে। অধুনা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রায় প্রতিটি দলেরই আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হওয়া সত্ত্বেও প্রায়োগিকভাবে এর প্রতিফলন কতটা ঘটছে, তা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত নানা ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুক্তসমাজ প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে আইনের শাসন, সীমিত সরকার এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের চিন্তা-চেতনা ও ধারণার সমন্বিত প্রয়াস। এরই ভিত্তিতে বিভিন্ন স্বৈরতন্ত্রের ঘৃণ্য নীতিমালাকে পর্যদুস্ত করে গণমানুষের ইচ্ছাশক্তি, ঋজুতা ও সৃষ্টিশীলতার অবারিত ক্ষেত্র মানবতাবাদের বিজয়কে নিশ্চিত করেছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, পরশ্রীকাতরতা-প্রতিহিংসাপরায়ণতা সংহার করে পর্যাপ্ত আলোচনা-সমঝোতার ভিত্তিতে নাগরিক স্বাধীনতা ভোগের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কার্যক্রম সচল থাকে। জনগণের স্বাভাবিক জীবন নির্বাহের অধিকার নিশ্চিত করতে পবিত্র সংবিধান হয়ে থাকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার উৎস।
২৪০০ বছর আগে হেরোডেটাস (৪৮৪-৪২৪ খ্রিষ্টপূর্ব) কর্তৃক প্রণীত গণতন্ত্রের ধারণাকে এখনো স্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর কাছাকাছি মনে করা হয়। আদিম মানবগোষ্ঠীর সহজ-সরল শাসনব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধরে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণ গণতন্ত্রকে বেছে নেবে-এ ইঙ্গিত প্রায় সব সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে গেছে। আমরা জানি, প্রাচীন গ্রিস ও রোমের সরকার পরিচালনায় নাগরিকের অংশগ্রহণের অধিকার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রিসে সীমিতসংখ্যক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা সরাসরি ভোট দিত; কিন্তু এসব গণতন্ত্রে নিুবিত্ত কিংবা ক্রীতদাসদের কোনো স্থান ছিল না। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু আগে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট সরকার চালু ছিল। ইংল্যান্ডে প্রায় হাজার বছর আগে হাউজ অব ল’স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডে আইন প্রণয়নে হাউজ অফ কমন্সের অংশগ্রহণ কারও অজানা নয়।
সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংখ্যালঘিষ্ঠতার বিভাজনে সংসদীয় শাসন পরিচালনা করত। এ সংসদীয় কাঠামো বজায় রেখে ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক পরে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও বহুকাল ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। আধুনিককালে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগে নির্বাচিত ব্যক্তিদের আইন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনার যে ব্যবস্থা, তাকেই বর্তমানে গণতন্ত্রের মূল প্রত্যয় হিসাবে অভিহিত করা হয়। মূলত এর উৎপত্তির পেছনে রয়েছে শিল্পবিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তির গোড়াপত্তন তথা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার চেতনার বাস্তব অভিব্যক্তি। এর সর্বোত্তম স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞায়-Government of the people, by the people and for the people. যদিও ইংল্যান্ডে বেশ কিছুকাল আগে রাজা কর্তৃক নাগরিকদের সনাতন অধিকার খর্ব করার প্রতিবাদে সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘটিত সংঘাতের ফলে প্রণীত The Petition of Right, 1628 এবং The Bill of Rights, 1689 রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনসভা ও বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গণতন্ত্রের আদর্শকে উজ্জীবিত করার ধারাবাহিকতায় ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর লাস্কির ভাষায়-‘কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকার দ্বারা’ এবং গণতন্ত্রকে যথার্থ মর্যাদায় আসীন রাখতে পারে জনগণের সঠিক চেতনা ও সতর্ক পাহারা, যেটি লাস্কির ভাষায়-eternal vigilance is the price of liberty। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর ক্ষমতা চর্চার প্রচলনও দৃশ্যমান ছিল। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা করা হলেও এটি গণতন্ত্রকে সবচেয়ে কম স্বৈরাচারী, সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, সবচেয়ে কম কঠোর এবং সবচেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল বলে অনেক মনীষী ধারণা পোষণ করেছেন। অনেকে গণতন্ত্রের দুর্বলতা, অপূর্ণতা ও অপপ্রয়োগ স্বীকার করেও এর অপরিহার্যতার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন।
আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসাবে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১তম অনুচ্ছেদের ৩নং ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা, যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সর্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গোপন ভোটের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন’-জাতিসংঘ ঘোষিত এ নীতিমালা গণতান্ত্রিক ধারাকে সমগ্র বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আধুনিক গণতন্ত্রের বিজ্ঞ তাত্ত্বিক লিন্ডসের ভাষায়-গণতন্ত্র একটি সামাজিক প্রক্রিয়াও বটে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে, সমাজে বিরাজমান বৈষম্য নিরসনে গণতান্ত্রিক বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নানামুখী উপাদান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। সহিংসতা-বিরোধ-বিচ্ছেদ নয়, সৌহার্দ-সম্প্রীতি-সহিষ্ণুতাই মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মৌলিক ভিত্তি হিসাবে বিবেচ্য। আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নাগরিকরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে, এটাই সময়ের জোরালো দাবি।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়