শিক্ষাঙ্গনে অচলাবস্থা সৃষ্টির দায় কার?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুই সপ্তাহ ধরে দেশের শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার অঙ্গন স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়েই শিক্ষাঙ্গন। ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন করছেন। অন্যদিকে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে ক্যাম্পাসের সীমানা পেরিয়ে রাজপথ অবরোধ করছে শিক্ষার্থীরা। অথচ এ ইস্যুগুলো ছিল পূর্বমীমাংসিত; নতুন করে এগুলোকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে মাত্র। অনেকেই বলেন, এদেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। তবে এ দুটি ইস্যুতে সরকারের ভূমিকা দেখে বোঝা যায় এদেশে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা কার্যকর আছে। সাংবাদিকদের দু-চারটি প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই সরকারি মহলের। এ দুটি বিষয় নিয়ে সামান্য আলোচনার ইচ্ছা পোষণ করছি।
‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন চলছে। এটি একটি মীমাংসিত বিষয় ছিল। সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে সংস্কারের মাধ্যমে একটি যৌক্তিক কোটা পদ্ধতি চালুর দাবিতে দেশের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে আন্দোলনের স্বার্থে রাজপথে নেমে আসে। সেসময় যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী ক্ষমতাবলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সব ধরনের কোটা বাতিল করেন এবং এ বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। তাই ২০১৮ সালের পর থেকে সরকারি চাকরি আজতক কোটামুক্ত। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো দুজন শিক্ষার্থীর আদালতে আপিলের রায় ঘোষণার পর। ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রের বিরুদ্ধে দুজন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের দাবি করে হাইকোর্টে আপিল করেন। সেই আপিলে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের আদেশ দেন। সেই আদেশে সংক্ষুব্ধ হন শিক্ষার্থীরা। সরকারের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। আপিল বিভাগ ১০ জুলাই হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা আদালতের পরিবর্তে বিষয়টির নিষ্পত্তি চান নির্বাহী বিভাগ থেকে। তাই তারা এখনো রাজপথ দখল করে আছেন। আদালতে বিবেচনাধীন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সমীচীন নয়। এক মাস পর আদালত তার পর্যবেক্ষণ নিয়ে যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করবেন, তার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করাই শ্রেয়।
তবে এর বাইরে একটি বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, যা আমাকে বিব্রত করে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও আমি এরকম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম। বিষয়টি হলো, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবার সাত সন্তানের কেউ-ই মুক্তিযোদ্ধার বিশেষ কোনো সুবিধা ভোগ করেনি বা কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি। কিন্তু কোটা বাতিলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানের বিষয়টিকে সামনে আনা আমার জন্য বিব্রতকর। সম্মান বা মর্যাদার সঙ্গে বিশেষ সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে দায়িত্বের প্রশ্ন আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন; একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে গিয়ে অঙ্গ হারিয়েছেন, হারিয়েছেন কর্মক্ষমতা; একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে যাওয়ার কারণে চাকরি হারিয়েছেন; একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে; তাদের ও তাদের পরিবারের প্রতি স্বাধীন দেশের সরকারের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? অবশ্যই আছে এবং থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধর সন্তান যাতে প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্যসুবিধা পায়, যাতে মানসম্পন্ন শিক্ষাসুবিধা পায়, তা সুনিশ্চিত করা উচিত। এর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাড়তি কোনো সুযোগ রাখা সমীচীন নয়। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যতদিন চাকরি জোগাড় করতে না পারবে, ততদিন বেকার ভাতা প্রদানেও কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যোগ্যতার ভিত্তিতেই কাউকে চালকের আসনে বসতে হবে। যে কোনো কোটা সার্বিক উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে, প্রকৃত মেধাকে নিরুৎসাহিত করে। তারপরও আমাদের প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর নৃ-গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে কোটাপ্রথা বাতিল না করে এর সংস্কার করলে ভালো হয়। সেক্ষেত্রে মোট কোটার পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
প্রকৃত সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমাদের স্বাধীনতার মূল সনদ তৈরি হয়েছিল তিনটি চেতনাকে সামনে রেখে-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এর ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে রচিত হয় আমাদের সংবিধান এবং এর মূলনীতি হলো-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৩ বছর ধরে অধিষ্ঠিত সরকারগুলো ওই নীতিগুলো থেকে ক্রমাগত সরে এসেছে। আজ মূলনীতির প্রায় কোনোটিরই অবশিষ্ট নেই। তাই মাঝেমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকে সামনে এনে মানুষকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করা হয়। দুঃখটা এখানেই। যে শাসকগোষ্ঠীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা উপেক্ষিত, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার সহানুভূতি মায়াকান্নার বেশি নয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ১ জুলাই থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। স্বভাবতই ক্যাম্পাসগুলোয় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ইস্যু কী? জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ‘প্রত্যয় স্কিমে’ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাবেন, তাদের এ স্কিমের আওতায় নেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা এ বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন তিন মাস ধরে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বাদ-প্রতিবাদে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই শিক্ষকরা চূড়ান্ত কর্মসূচি নিয়েছেন। শিক্ষকরা মনে করেন, কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত, অযৌক্তিক, বিদ্বেষমূলক, বৈষম্যমূলক এবং উচ্চশিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস মাত্র। শুধু তাই নয়, এ ‘প্রত্যয় স্কিমের’ ফলে সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, তা তিরোহিত হবে। এর পক্ষে অনেক কার্যকর যুক্তি আছে।
পেনশন সুবিধা প্রদানের কারণ হলো, একজন নাগরিককে তার অবসরকালীন আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া। সেই মতে, যারা সরকারি চাকরি করেন, তারা অবসর শেষে পেনশন সুবিধা পেয়ে আসছেন; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষরাও সেই পেনশন সুবিধার আওতাভুক্ত। কিন্তু একটি সামাজিক প্রশ্ন হলো, যারা সরকারি চাকরি করেন না, তারাও তো একদিন অবসরে যাবেন কিংবা যারা প্রকৃত অর্থে কোনো চাকরিই করেন না, তাদেরও তো বয়স হবে, তারাও তো একদিন স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন, তাদের সামাজিক সুরক্ষা কীভাবে দেওয়া যায়? এ সামাজিক ও যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর হিসাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির কথা অন্তর্ভুক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেন। সেখানে চারটি স্কিমের কথা বলা হয়েছে-এক. প্রবাসী-যারা বিদেশে থাকেন, তারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন; দুই. প্রগতি-যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, তারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন; তিন. সুরক্ষা-যারা স্বকর্মে নিয়োজিত, তারা এর আওতায় পড়বেন এবং সমতা-যারা নিু-আয়ের মানুষ, তারা এর আওতাভুক্ত। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যারা প্রচলিত সরকারি পেনশনের আওতায় নেই, তাদের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করেছে সরকার। সরকারের এ উদ্দেশ্যকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল।
কিন্তু জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ‘প্রত্যয়’ নামে নতুন একটি পেনশন স্কিম চালু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এর অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন এ স্কিম কতটা ভালো-মন্দ, সে প্রশ্ন পরে। কিন্তু সবার আগের প্রশ্নটি হলো, যে শিক্ষক প্রচলিত পেনশন সুবিধার আওতায় ছিলেন, তাকে সেখান থেকে বাদ দেওয়া হলো কেন? এ বঞ্চনার উদ্দেশ্যটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রচলিত পেনশনের আওতায় সরকারের আরও বিভাগ রয়েছে; কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি এ অন্যায় আচরণ কেন? এর যথাযথ উত্তর এবং এর আশু সমাধান আমরা আশা করছি।
শুরুতেই বলেছি, কোটা ও পেনশন ইস্যু দুটি মীমাংসিত বিষয়। ২০১৮ সালেই কোটার বিষয়টির মীমাংসা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রচলিত পেনশন সুবিধার মধ্যেই ছিলেন। তাহলে এ দুই ইস্যুতে কেন শিক্ষাঙ্গন অচল হলো? কেন শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে আসতে হলো? এরকম শত প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলা ভার। নীতিনির্ধারকদের কাজকর্ম দেখলে মনেই হয় না এদেশে কোনো শাসনব্যবস্থা আছে। যে যা পারছে, তা-ই করছে। এখানে দেখভাল করার কেউ নেই; জবাবদিহি নামে কোনো শব্দ নেই, নেই স্বচ্ছতার কোনো অস্তিত্ব। সুতরাং, সবকিছুরই হয়তো সমাধান হবে একসময়। তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরে যা পাওয়া যাবে, তা ক্ষয়ক্ষতির আগেই সমাধা করতে পারি না কেন-সেটা হলো বড় প্রশ্ন।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়