স্বদেশ ভাবনা
ব্যাখ্যা করলে অন্য অর্থ বেরোয়
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
গত ২৩ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বলেই বারবার জনগণ ভোট দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দুইভাগে পর্যালোচনা করতে চাই। প্রথম ভাগের পর্যালোচনার বিষয় ‘বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।’ ‘গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকা’ নিয়ে পর্যালোচনা থাকছে দ্বিতীয় ভাগে।
এটা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার, যেটি স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রথম সরকার, তাদের সাড়ে তিন বছরের (১৯৭২-৭৫) মেয়াদকালে জাতীয় জীবনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয় দলটি। এ সরকারের আমলে রচিত হয় দেশের সংবিধান, যা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। এ সরকারের আমলে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান একটি প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার গঠিত সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটির অন্তর্বর্তীকালীন সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তর করা হয়।
সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ইত্যাদি বাস্তবায়নের জন্য কিছুসংখ্যক সংযুক্ত দপ্তর, অধস্তন অফিস এবং স্বশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো এবং বেসামরিক চাকরি পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের নীতি কী হবে, তা নির্ধারণে গঠিত হয় ‘প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ কতিপয় উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হলে প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রথমে প্রধান সামরিক প্রশাসকের এবং পরে রাষ্ট্রপতি পদেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যা সংক্ষেপে বিএনপি নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। জিয়াউর রহমানের একটি অনন্য অবদান পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনর্বহাল।
জিয়াউর রহমান নিয়োগকৃত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে বিএনপি সরকার ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন)’ আদেশ জারি করে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৪টি সার্ভিস ক্যাডার। তবে ক্যাডারগুলোর প্রতিটির একাধিক সাব-ক্যাডার থাকায় মোট ক্যাডারের সংখ্যা বাস্তবে দাঁড়ায় ২৮টিতে। গত ৪৪ বছরে দু-একটি ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন/সংশোধনসহ ১৯৮০ সালে বিএনপি সরকার প্রবর্তিত সিভিল সার্ভিস কাঠামো এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।
বিএনপির সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করে। অর্থনৈতিক নীতিতে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি। এটির শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমান নেতৃত্বাধীন বিএনপির শাসনামলে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফর করে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের শাসনামলে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) জিয়াউর রহমানের প্রচেষ্টার ফসল।
জেনারেল এইচএম এরশাদ সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে নয় বছর (২৪ মার্চ ১৯৮২ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) দেশ শাসন করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি প্রশাসনিক সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। ‘মার্শাল ল কমিটি’ এবং ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি’ নামে দুটি কমিটি গঠিত হয়। মার্শাল ল কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং এর অধীন বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরগুলোর জনবল কাঠামো, যানবাহন ও অফিস ইকুইপমেন্ট ইত্যাদির সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রশাসনের এসব খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অপচয় বহুলাংশে কমে আসে। এসব অফিসে জনবল কাঠামো, যানবাহন ও অফিস ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি পুনর্নির্ধারণে এখনো উপর্যুক্ত ‘মার্শাল ল কমিটি’ অনুমোদিত কাঠামোকে মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
এরশাদ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি’র সুপারিশের আলোকে তিনি থানাকে উপজেলা এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করেন। বিশেষ করে উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তন ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সরকারের বিভিন্ন অফিস ও আদালত স্থাপনের ফলে উপজেলাগুলো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মহকুমা জেলায় উন্নীত হওয়ার ফলে জেলার সব সুযোগ-সুবিধা জনগণের অনেকটা কাছে চলে আসে। স্থানীয় সরকার কাঠামোয় যুগান্তকারী সংস্কারের জন্য এরশাদ অমর হয়ে থাকবেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও প্রয়োজনের তাগিদে আওয়ামী লীগ সরকার তা আবার চালু করে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত ঘোষিত সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করে, যা বর্তমানেও চালু রয়েছে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে এ সরকার সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯৬ সালের মার্চে জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের এ মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) অর্জনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি এবং যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্নকরণ।
২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার সরকার গঠন করে। এ সরকারের আমলে রাজধানীর যানজট লাঘবে স্থাপিত হয় প্রথম উড়াল সেতু।
সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ দুবছর (জানুয়ারি ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮)। এ সরকারের একটি বড় অবদান হলো নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবহার।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে দেশ শাসন করছে। তার সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের অধিক একটানা শাসনামলে উন্নয়নের চলমান প্রক্রিয়ায় ম্যাক্রো-ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টে উন্নয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু জাতীয় আয় দাঁড়িয়েছে ২,৭৮৪ মার্কিন ডলারে, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৯০ মার্কিন ডলার (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯ এবং ২০২৪)। অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বহুমুখী পদ্মা সেতু নির্মাণ ও চালুকরণ, চট্টগ্রাম শহরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ৩.৩২ কিলোমিটার টানেল নির্মাণ ও চালুকরণ, রাজধানীর যানজট নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুকরণ, রাজধানীর বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুকরণ। সরকারি হিসাবে ২০১০ সালের ৩১.৫০ দারিদ্র্য হার ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। স্বাধীনতা সময়কালীন এক কোটি টন চালের উৎপাদন বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দারুণ সাফল্য এসেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
উপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারের আমলে কম-বেশি উন্নয়ন হয়েছে এবং মানুষ সে উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে যে উন্নয়ন করেছে, তা দলটির একটানা শাসনকালের দীর্ঘতা বিচারে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়।
এবার দ্বিতীয় বিষয় অর্থাৎ ‘গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকা’ নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। ২০০৯-২০২৪ সময়কালে দেশে তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এসব নির্বাচনের কোনোটিই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিএনপি সরকার কর্তৃক ১৯৯৬ সালের মার্চে প্রবর্তিত নির্দলীয় সরকারব্যবস্থায় নবম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে বাতিল করে। জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা আটটি দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে। এতে ওই নির্বাচন অনেকটা একদলীয় রূপ নেয়। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। অনেকটা একদলীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আওয়ামী লীগের এমন আশ্বাসে বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নির্বাচনের দিন নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দলের অনেকে নির্বাচন বয়কট করে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল-নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। এ নির্বাচন দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়ে আসছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘দ্য ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জালভোট দেওয়া হয়েছে এবং বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ দেড় ডজনের মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বর্জন করে। এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সরকারি দল নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়। ‘ডামি’ নির্বাচন হিসাবে পরিচিতি পাওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ১১টি আসন বাদে বাকি সব আসনে শাসকদল আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জয়লাভ করে। এ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড’ মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে পারেনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
উপর্যুক্ত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ বিএনপি মনোভাবাপন্ন অনেক বিরোধীদল অধিকাংশ সময় এসব নির্বাচন বয়কট করেছে এবং বর্তমানেও বয়কট করছে। সুতরাং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঘাটতি রয়েছে। যেহেতু গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং যেহেতু এরূপ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, সেহেতু দেশে গণতান্ত্রিক ধারা পুরোপুরি অব্যাহত আছে বলে ধরে নেওয়া যায় না।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com