মূল্যস্ফীতি কমানোর আলাপ কি বাদ দিতে হবে?
হাসান মামুন
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গেল বছর কাঁচা মরিচের দাম বাড়তে বাড়তে হয়ে গিয়েছিল কেজিপ্রতি ৭০০ টাকা। এবারও কাছাকাছি সময়ে এর দাম বাড়তে শুরু করেছে এবং কারণ অভিন্ন-তাপপ্রবাহ; এরই মধ্যে ঝড়বৃষ্টি বেড়ে যাওয়া। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সময়টায় কাঁচা মরিচের ঘাটতি হয়ে থাকে। সময়মতো আমদানি প্রয়োজন। গেল বছর এটা আমদানি করতে হয়েছিল ভারত থেকে। এবারও হয়তো কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। আমদানি ব্যয় কম পড়লে এটা কমে বিক্রি করা যাবে। তাতে কমে আসবে দাম।
প্রসঙ্গটা তোলা হলো বলতে যে, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বোধহয় শিখছি না। সংকট সৃষ্টির পর নিচ্ছি সিদ্ধান্ত। ততক্ষণে ভোক্তার পকেট যাচ্ছে খালি হয়ে আর এটা ঘটছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি এখন। বিআইডিএস-এর হিসাবে আরও বেশি। অন্যরা বলছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ অবস্থায় কাঁচা মরিচের দাম বাড়লে সেটাও গায়ে এসে লাগবে। অবস্থা বুঝে তা আমদানি করা যেতেই পারে। এক্ষেত্রে এলসি জটিলতা হবে না। সরকার তো আমদানি অনেক কমিয়ে এনেছে এর মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের আমদানিও কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কাঁচা মরিচ আমদানিতে তাই বেগ পেতে হবে না।
খাদ্যশস্য আমদানি অবশ্য ধারাবাহিকভাবে কমছে ভারত থেকে। তারা রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করাতেও এমনটি ঘটছে। তবে কাঁচা মরিচ রপ্তানি বোধহয় নিরুৎসাহিত করছে না। সম্প্রতি পেঁয়াজ আমদানির সুযোগও তৈরি হয়েছে দেশটি থেকে। তবে দামে পোষাচ্ছে না বলে আমদানি কম। এদিকে মাসখানেক আছে কুরবানি ঈদের। খামারে গরু কিনতে ‘বুকিং’ দেওয়ার খবর মিলছে। গরু পালন ব্যয় বেশি বলে এবার গরুর দাম নাকি বেশি। মসলার বাজারের খবরও ভালো নয়। চোরায় পথে চিনি আসার খবর রয়েছে। মসলার দামে দুদেশে অনেক ব্যবধান থাকলে সেটাও চোরায় পথে আসবে। কাঁচা মরিচের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এটাও চোরায় পথে এলে অবাক হওয়া যাবে না।
খামারিদের কারও কারও অভিযোগ-কিছু গরুও আসছে চোরায় পথে। দেশ কুরবানির গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দাম অনেক। এ কারণে গোমাংসের দামও কমছে না। মাঝে নানা কাণ্ডকীর্তির পর বাজারটা ফিরে এসেছে আগের অবস্থায়। গোমাংসের দাম কমাতে এটাও আমদানির প্রস্তাব রয়েছে। এতে অবশ্য উচ্চহারে আরোপিত আছে কর-শুল্ক। আগামী বাজেটে যে ৩০০ পণ্যে শুল্কছাড়ের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে গোমাংস আছে কি? ভারত থেকে আনলে অবশ্য আনতে হবে মহিষের হিমায়িত মাংস। বিদ্যমান শুল্কেও এর দাম নাকি পড়বে অনেক কম। ‘সুনিয়ন্ত্রণে’ রাখা গেলে খামারিদের ওপরও এর বেশি প্রভাব পড়বে না। সবাই আমদানিকৃত মাংস খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তা তো নয়।
৪৫০-৫০০ টাকা কেজিতে হিমায়িত মাংস কেনাও বহু মানুষের জন্য কঠিন এখন। ব্রয়লার আর সোনালি মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায়ও তারা বাড়তি সমস্যায় পড়েছে। মাছের দাম বেড়েছে নতুন করে। রমজানের পর এটা প্রত্যাশিত ছিল না। নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ নাকি এজন্য মূলত দায়ী। গ্রীষ্মকালীন সবজির দামও বেশি। এ অবস্থায় কাঁচা মরিচের দাম বাড়লে সেটা খবর হবে বৈকি। পেঁয়াজ আর আলুর দামও গেলবারের একই সময়ের তুলনায় অনেক। এ অবস্থায় খোদ সরকারকে চাল আমদানিতে নামতে হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। তাপপ্রবাহ ও ঝড়বৃষ্টিতে বোরো মার খেলে চাল আমদানি করতে হবে বৈকি। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতকে কিছু চাল আনার অনুমতি দিয়ে রাখা হয়েছে। তারা অবশ্য আমদানি করবে পরিস্থিতি বুঝে। এ খবর স্বস্তির যে, আগামী বাজেটে সরকার খাদ্যশস্য আমদানি বাবদ বেশি বরাদ্দ রাখছে। অর্থাভাবে আমদানি যেন ব্যাহত না হয়। তবে সরকারিভাবে চাল আমদানি করতে না হলেই ভালো। বরং উচিত দেশীয় কৃষকের কাছ থেকে কিনে মজুত বাড়ানো। এতে কৃষকের ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা। মজুতটাও বাড়ানো দরকার এজন্য যে, সামনে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিগুলো জোরদার করতে হবে। দারিদ্র্য পরিস্থিতির তো অবনতি ঘটছে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে। সেটা প্রকাশ পাচ্ছে বিবিএস-এর জরিপেও।
কাঁচা মরিচ অবশ্য বেশি লাগে না; আর এর ঘাটতিও থাকে না বেশি দিন। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে এর সম্পর্কও সামান্য। তবে চালসহ ডজনখানেক পণ্য রয়েছে, যেগুলোর বাজার শান্ত না থাকলে নিু ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিপদ। তারা তো দেশের সংখ্যাগুরু। তারা বিপদে থাকলে দেশ ভালো আছে বলা যাবে না। তবে ডলারের দাম রাতারাতি বেড়ে যাওয়াসহ যেসব ঘটনা এরই মধ্যে ঘটল, তাতে সাধারণ মানুষের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত চাল আমদানি করতে হয়নি বললেই চলে। তবে আর সব পণ্য আমদানি করেই চাহিদা মেটাতে হয়েছে। এখন ডলারের দাম আরও বাড়লে এগুলো আনতে হবে আরও দামে। সুদের ওপর ‘ক্যাপ’ তুলে দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচও বাড়ছে। ডলারের পাশাপাশি টাকাও এখন দামি। আর এ পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে একটা নীতির আওতায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এর বাস্তবায়ন দেরিতে হলেও করতে লেগেছে। তাতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। অথচ এটা কমানোই ছিল লক্ষ্য।
খাদ্যপণ্যে আমরা ভারতের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে অবশ্য ভিন্নকথা ছিল। কুরবানির গরু তৈরির খাদ্যটাও আমাদের আনতে হয় প্রধানত আমদানি করে। ভারত থেকে আনতে না পারলে দূরবর্তী দেশ থেকে-বেশি সময় ও দাম দিয়ে। এদিকে ধান, শাকসবজি প্রভৃতির উৎপাদনে লাগে বিপুল পরিমাণ ডিজেল ও সার। ডিজেলটা পুরোই করতে হয় আমদানি। সারও আমদানি করতে হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। সারের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েও আমরা কিন্তু এর সদ্ব্যবহার করতে পারছি না গ্যাসের অভাবে। গ্যাসেরও একাংশ (এলএনজি) করতে হচ্ছে আমদানি।
এ অবস্থায় সুদের হার বাড়িয়ে অর্থ সরবরাহ কমানোটা অন্যান্য দেশে দ্রুত সুফল দিলেও এখানে দেবে বলে মনে হয় না। আমদানি আর উৎপাদনে ব্যয় বেশি পড়ছে বলে এদেশে মূল্যস্ফীতিটা ঘটছে আসলে অন্যদিক দিয়ে। এতে আবার বিনিয়োগ কমে গিয়ে কর্মসংস্থান আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে লক্ষ্যমাত্রার অনেকখানি কম। আগামী অর্থবছরে কি এটা বাড়বে? তিন মাস পরপর এর যে হিসাব আজকাল দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রবৃদ্ধিতে কৃষির ভূমিকাই ভালো। শিল্প ও সেবা খাত আছে সংকটে। আমদানির চিত্রেও এটা প্রতিফলিত। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি মেশিনারিজ আর কাঁচামাল আমদানিও অনেক কমে এসেছে। হঠাৎ কোনো কোনো মাসে এটা বাড়ে হয়তো-বিশেষ কোনো পণ্যের আমদানি বাড়ায়। যেমন: মাঝে কয়লা আমদানি অনেক বেড়েছে। কারণ, গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে সরকারকে। হালে বিদ্যুৎও আমদানি হচ্ছে আর সেটা ভারত থেকে।
এর মধ্যে কাঁচা মরিচ এনে পরিস্থিতি সামলানো হলে সেটা মোটেও বড় খবর হবে না। তাও ভালো, প্রতিবেশী দেশ থেকে দ্রুত আনা যাবে। চিনি তো আনতে হচ্ছে সুদূর ব্রাজিল থেকে। গম কানাডা, অস্ট্রেলিয়া থেকে। অবশ্যই বেশি দামে। প্রশ্ন হলো, এসব পণ্যে আরোপিত উচ্চ কর-শুল্ক কি কমানো হবে? রমজানের পর সয়াবিন তেলে ভ্যাট ছাড়ের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ায় এর দাম আবার বেড়েছে। এসব পণ্যের বাজার শান্ত রাখার চেষ্টা হচ্ছে আসলে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে। এ অবস্থায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, শুল্কহার ‘যৌক্তিকীকরণের’ বিষয়টি তার হাতে নেই। এটি যার হাতে রয়েছে, তার সামনে এখন সুযোগ বাজেটে কিছু জোরালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার। যেমন: ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যগুলোয় তাৎপর্যপূর্ণভাবে কর-শুল্ক কমিয়ে এটাকে সমমানের দেশগুলোর সমান করার। এদেশে আমদানিতে শুল্ক অনেক এবং এর মাশুল দিতে হচ্ছে মূলত তাদের, যারা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আয় বাড়াতে অক্ষম। রাজস্ব বাড়াতে সরকার আর কতদিন এর সহজতম উৎস আমদানি খাতের ওপর নির্ভর করে থাকবে, সেটাও বোধগম্য নয়। তবে সময় এসেছে জনপ্রশাসন পরিচালনা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর এবং আয়কর বাড়ানোর। এটা করা গেলে আয়বৈষম্য হ্রাসেও ভূমিকা রাখতে পারবে সরকার।
ডলারের দাম, সুদের হারসহ গ্যাস-বিদ্যুৎ-ডিজেলের দাম সরকার নিকটভবিষ্যতে কমাতে পারবে বলে মনে হয় না। উন্নয়ন ব্যয়ের নামে অপচয় রোধ করা এ অবস্থায় জরুরি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তৈরির দাবিদারদের তো ব্যবসার পরিবেশ সুস্থ করার কথা। এর সনদ পেতে আর তা নবায়ন করতে যেন ঘুস না লাগে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদেরও যেন নিয়মিতভাবে চাঁদা দিতে না হয়। চাঁদাবাজির কারণে পণ্য পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যাওয়াটা এদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। শুধু ‘ইউক্রেন যুদ্ধের’ কথা না বলে নজর দিতে হবে ভেতরগত এসব সমস্যার দিকে। পণ্যের হাতবদলও কমাতে হবে। ‘স্বাভাবিক মুনাফায়’ ব্যবসায় অভ্যস্ত হতে হবে ব্যবসায়ীদেরও। এ লক্ষ্যে বাড়াতে হবে মনিটরিং। সরকারের কাজ আসলে মনিটরিং; ব্যবসা নয়। সরকার তো দক্ষভাবে, কম ব্যয়ে ব্যবসা করতেও শিখছে না। বিদ্যুৎ খাত এর প্রমাণ। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে খরচ পোষাচ্ছে সরকার। জ্বালানি খাতেও জবাবদিহি না বাড়িয়ে ডিজেলের দাম ‘সমন্বয়’ করছে মাসে মাসে। কে জানে, সামনে ডলারের দাম আরও বাড়বে কি না। দাম বাজারভিত্তিক হলে বেশি নাও বাড়তে পারে। সুদের হারও একটা জায়গায় এসে থিতু হবে। এর পাশাপাশি যেসব কাজ করলে মূল্যস্ফীতি অন্তত কিছুটা সহনীয় থাকার কথা, সেগুলোর কতটা কি করা যাবে-কে জানে। তাত্ত্বিকভাবেই শুধু কিছু কথা বলা যেতে পারে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক