সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর হাতের স্পর্শ পাওয়া সরোদটি ২০২১ সালে আক্রমণের শিকার হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরোনো জেল রোডে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভিটেবাড়িটির অবস্থান। সরকারি অনুদানে বাড়িটিকে একটি দুর্লভ প্রদর্শনশালায় গড়ে তোলা হয়েছিল। শত শত সংগীতপ্রেমী এ বাড়িতে এসে তাদের প্রাণের উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন এত বছর ধরে; কিন্তু আজ পুরো বাড়ির ভেতরে ও বাইরে শুধুই অন্ধকার। ভস্মের ঢিপির মধ্যে আধপোড়া কাঠের মতো মাথা উঁচু করে রয়েছিল আলাউদ্দিন খাঁর সরোদটি। এককোণে পড়েছিল ডুগির হাঁড়ি, যার চামড়া পুড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। মেঝে থেকে ছাদছোঁয়া লকলকে আগুন গিলে খেয়েছিল সবকিছু। আগুনের লেলিহান শিখায় পুরোনো দালানের আস্তর খুলে পড়েছিল-বেরিয়ে এসেছিল লাল রঙের ইট। মনে হয়েছিল, দগ্ধ চামড়া মাঝে-মধ্যে ওঠে গিয়ে রক্তলাল মাংস বেরিয়ে এসেছে। শুধু শুনেছিলাম তা-ই নয়; মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম, সংগীত-সুর এসব তো কারও ক্ষতি করে না! সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। বলেছিলাম, তাই বলে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরোদও রেহাই পাবে না?
আজ আবার বলতে হচ্ছে, তাই বলে রেহাই পাবে না ঋত্বিক ঘটকও? ২০২৪-এর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এর পরদিন লোপাট হয়ে গেছে বাংলা সিনেমার প্রবাদপুরুষ ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি। রাজশাহীর ঘোড়ামারার মিয়াপাড়ায় ঋত্বিক ঘটকের ওই বাড়িতে তিনি তার জীবনের শুরুর দিকে অনেকদিন কাটিয়েছিলেন। ওই বাড়িতে থেকেই তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। সেখানে থাকাকালে মিয়াপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগারের মাঠে নাট্যচর্চা করেছেন। এ বাড়িতেই যাতায়াত ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, উদয় শংকর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ বাহাদুর খানসহ কত নামি-দামি মানুষের। কিন্তু আজ পুরো বাড়িই হারিয়ে গেছে! বাড়িটার পাশে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে; শুধু পাঁচ বিঘা জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি উধাও, শাবলের ঘায়ে মাটিতে মিশে গেছে। ঋত্বিকের মতো সিনেমার মহান কারিগরের জন্ম বাংলাদেশ হলেও একসময় তিনি উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। এবার তার ফেলে যাওয়া বাড়িটিও হয়ে গেল উদ্বাস্তু।
সম্রাট আকবরকে তার রাজসভার বিশেষ সভাসদ বীরবল বলেছিলেন, সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য মাত্র চার আঙুলের। ব্যাখ্যা করেছিলেন-আমরা যা দেখি, তা সত্য; কিন্তু যা শুনি, তা সত্য না-ও হতে পারে। চোখ-কানের মধ্যে মাত্র আঙুল চারেক দূরত্ব। সেদিন শুধু আকবর নন, বীরবলের এ যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন তার সাম্রাজ্যের অন্য সভাসদরাও। কিন্তু আজকের সোশ্যাল মিডিয়া ও এআই-এর যুগে যা-ই চোখে দেখছি, তা সত্য না-ও হতে পারে। কাজেই আজকের দিনে সত্য আর মিথ্যার দূরত্ব মাপার সুযোগ নেই। এখন কার মুখে কে কথা বলবে, কে কার মুখ হয়ে উঠবে-একেবারেই তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ, তার অনেকটাই আজ আঙুলের নিয়ন্ত্রণে। এসব কারণে সমাজের অন্যতম নির্ধারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে গুজব। মানুষের যেখানে পরিষ্কার ধারণা নেই, অথচ আগ্রহ আছে-সেখানেই গুজবের জন্ম। পূর্বে ‘চিলে কান নিল’ বললে কেউ বলতে পারত, চিলের পেছনে না দৌড়ে আগে কানে হাত দাও; কিন্তু এখন তো সে মজাও শেষ। কান যে নেই, তা-ও এআই-এর মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে পারে কেউ। আর সে কারণে আগের থেকে বর্তমানে অনেক বেশিই সক্রিয় গুজবের বাহাদুরি।
গুজব এখন উত্তাল পরিস্থিতি জন্ম দিতে পারে সহজেই; অনায়াসেই ডেকে আনতে পারে অশান্ত পরিস্থিতি। তার মধ্যে যদি মানুষ উদ্বেগ বা চিন্তায় থাকে, তাহলে সেখানে গুজব থাবা বসায় অনায়াসে। মধ্যযুগে একবার গুজব রটেছিল, শয়তানের প্ররোচনায় ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের কুয়োয় বিষ মিশিয়েছিল। যে কারণে পাঁচ হাজার ইহুদিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সংবাদমাধ্যম ‘এপি’-র টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে হ্যাকাররা লিখেছিল, হোয়াইট হাউজে বিস্ফোরণে বারাক ওবামা আহত হয়েছেন। সেই এক টুইটেই যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল। ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতের একটি গুজব সারা পৃথিবীতে ঝড় তুলেছিল। গণেশ দেবতা নাকি দুধ খাচ্ছেন। ভারত, নেপাল, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেখানে যেখানে হিন্দু মন্দির ছিল, সর্বত্রই দেখা গেল মন্দিরে অবস্থিত গণেশ দুধ খেয়ে নিচ্ছে। ভারতজুড়ে টান পড়ে যায় দুধের। নেপালের রাজা বীরেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রবাসী ভারতীয়রা রীতিমতো আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। মন্দিরে মন্দিরে দুধ নিয়ে যায় ভক্তরা এবং তারা দেখতে পান গণেশ দুধ খেয়ে নিচ্ছে। তারপরই বিজ্ঞানীরা ক্যাপিলারিটির থিওরি ব্যাখ্যা করলেন। প্রমাণ হয়ে গেল, গুজবের দুধ খেয়েছিল গণেশ। ওটা ধর্মীয় অনুভূতি ছিল না, ছিল গুজবের অনুভূতি।
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর তথ্যমন্ত্রী ছিলেন জোশেফ গোয়েবলস। গুজবের জন্য তিনি ছিলেন কুখ্যাত। তিনি বলেছিলেন, ‘একই মিথ্যা বারবার বললে সেটাই সত্যি হয়ে যায়’-গুজবের শক্তি এমনই। এমন শক্তিমান গুজব ২০২৪ সালে এসেও লন্ডভন্ড করে দিল অনেক কিছু। অনেক ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গুজব ছড়ানো হয়, সংখ্যাগুরু মুসলিম দেশে গুটিকয়েক হিন্দু সবকিছু খেয়ে ফেলছে। সরকারের বড় বড় জায়গায় তারা। ভারতের লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশের চাকরি-বাকরি সব দখল করে নিচ্ছে; বাংলাদেশে তাই বেকার সমস্যা-এমন শক্ত গুজব কারও কারও মাথা খারাপ করে দিল এই ২০২৪ সালে এসেও। শাবলের আঘাতে খান খান করা হলো স্মৃতির খোলসে বাঁধা ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটিও। কে বা কারা এ কাজের জন্য দায়ী, সেটাও সঠিকভাবে জানা হলো না। তবে এটি নিশ্চিত, এ কাজের জন্য যারা দায়ী, যারা তার বাড়ি ভেঙেছে-তারা বাংলা কিংবা বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীল নয়। তারা ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। স্বৈরাচার শাসন সরানোর দাবিতে পথে নামার ফাঁকে কেউ কেউ কখন যে নিজেদের ধ্বংসের বীজ রোপণ করে ফেলেছে, তা নিজেরাও টের পায়নি। এভাবে গৌরবময় ছাত্র আন্দোলন যে কলুষিত হতে পারে, তা তারা একবারও ভাবছে না। হিংস্র রাত্রি এসে তাদের আত্মচেতনার অর্গল ভেঙে চুপি চুপি সমাজজীবনের অন্তরে প্রবেশ করে হরণ করছে আমাদের জীবনের গৌরবের রূপ।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.net