কেমন হবে আগামীর রাজনীতি
মোহাম্মদ আবদুল মাননান
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনীতির গতকাল ও আজকের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কাল কী ঘটতে পারে তার একটা আভাস মিলে যায়। তবে সমাজবিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়, যে নির্দিষ্ট মাত্রার হাইড্রোজেন-অক্সিজেন মেশালেই পানি হয়ে যাবে। রাজনীতি সমাজবিজ্ঞানের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ-ফলে, রাজনীতি নিয়ে নির্দিষ্ট করে আগাম কিছু বলা খানিকটা দুরূহ বটে। আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদলের কয়েকটি বড় ঘটনা আছে। এ ঘটনাগুলো রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনেনি, কিন্তু প্রতিবারই ঘটনাগুলো ক্ষমতার উদাহরণযোগ্য পরিবর্তন এবং রাজনীতিতে বিশেষ শিক্ষা দিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার এবং ২০২৪ সালের আগস্ট বিপ্লব-এ দেশের রাজনীতিতে বিশেষ ঘটনা এবং এ চারটি ঘটনা কেবল প্রবল ক্ষমতাধর শাসকদের গদিচ্যুতই করেনি, বরং এ চারটি রাজনৈতিক পরিবর্তন আমাদের রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক-চিন্তক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য নানা শিক্ষার উপকরণ রেখে গেছে।
স্বীকৃত সত্য, ১৯৭১ সালে যুদ্ধশেষে আওয়ামী লীগ নতুন দেশে একটি সরকার গঠন এবং গঠিত সরকার পরিচালনায় সক্ষম ছিল। তখনো ক’খানা রাজনৈতিক দল ছিল বটে, কিন্তু সরকার চালানোর মতো না ছিল যোগ্যতাসম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দল, না একজন নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার যে খুব দ্রুত মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিল, তার প্রমাণ ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের দুরবস্থা এবং বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের মানুষকে ওই রকমের নির্মম হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ না হওয়া। আরও আশ্চর্যের এবং পরিতাপের যে, ’৭৫-এর ক্ষমতার পালাবদলের পর গঠিত সরকারের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ নামের দলটির লোক ছিল; এর মানেই হলো দলটির জনপ্রিয়তা প্রায় মাটিতে নেমে পড়েছিল এবং দলের নেতারাও অন্যত্র আশ্রয় খুঁজেছে। এরপর ব্রাকেটবন্দি আওয়ামী লীগ এবং নব্য বাকশাল, কোনোটিই পঁচাত্তর-পূর্ব আওয়ামী লীগের শক্তি অর্জন করতে পারেনি, জনপ্রিয়তাও পায়নি-বরং আওয়ামী লীগবিরোধী চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যে চেতনা ৭২-৭৫ সময়ে আওয়ামী লীগের অগোচরে শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আদতে একটি সরকার গঠন এবং তা পরিচালনার মতো দেশে রাজনৈতিক দল ছিল না-আর এ সুযোগটিই জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেছেন। প্রথমে জাগদল এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সৃষ্টি করে যোগ্য রাজনৈতিক দলের ঘাটতি পূরণ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত মানুষের ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট আওয়ামীবিরোধী চেতনা জিয়ার দলকে শক্তি জুগিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে অনেক ছোট দলও যুক্ত হয়েছিল-অবশ্য চুয়াত্তরেও বাকশালের সঙ্গেও কয়েকটি দল যুক্ত হয়েছিল। তবে এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, চুয়াত্তরে দেশকে অন্য দলবিলীন করায় অন্যদের বাকশালে শামিল না হয়ে উপায় ছিল না, কিন্তু বিএনপিকে আওয়ামীবিরোধী শক্তি বিবেচনা করেই একাধিক দল বিএনপিতে লীন হয়েছিল। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির জনপ্রিয়তারও ঊর্ধ্বে পৌঁছে যান জিয়া এবং তার দল। কেউ কেউ মনে করে, অভ্যুত্থানে মৃত্যু না হলে জনভোটে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা কঠিন হতো।
সত্য, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ধুলায় মিশে যায়নি। ২১ বছর লেগেছে পুরো শক্তি ফিরে পেতে। এর আগে দেশের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দল হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কেমন সেটা? ১৯৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট ভোটের ৭৩.২ পেয়ে ২৯৩টি আসন পেয়েছে। ১৯৭৯ সালে সেটা যথাক্রমে ২৪.৫৬ ও ৩৯টি আসন। ১৯৮৬ সালের বিএনপিহীন এরশাদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬.১৬ ভাগ ভোট পেয়ে ৭৬টি আসন পেয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সালে ভোটের দিক বিবেচনায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পার্থক্য মাত্র ০.৮০। আসন বিএনপি ১৪০ এবং আওয়ামী লীগ ৮৮। এখানে দেখার আছে, ’৭৫-এর সরকার বদলের পর আওয়ামী লীগের অবস্থা এবং ’৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির অবস্থা এক রকমের ছিল না। এরশাদীয় মন্ত্রিসভায় বিএনপির একাধিক নেতা যোগ দিলেও দলটির শক্তি ও জনপ্রিয়তা ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পর্যায়ে নেমে যায়নি।
সরকারের ওপর মানুষের আস্থা ও জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে সবক’টি সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সেটি বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপরও যায়। তবে বিএনপি দাবি করতেই পারে, জিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা ছিল। যুক্তি হিসাবে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার সৃষ্ট দলটি জনরোষানলে পড়েনি; বরং ২০০৯ সালের পর থেকে আজ অবধি বিএনপির জনপ্রিয়তা যাচাই হয়নি। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের এমন মতামত আছে, যে নির্বাচনে সরকার পড়ে যাওয়ার ব্যাপার ছিল না, তেমন (সিটি করপোরেশন-উপজেলা পরিষদ-ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনেও বিএনপির জনপ্রিয়তা যাচাই করে নিলে আওয়ামী লীগ ভালো করত; সেটা এ আগস্টের জনরোষ বুঝতেও খানিকটা সহায়ক হতে পারত।
এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসন দেখেছে, দেখেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একই দলের শাসন-অনুরূপ কথা খাটে বিএনপির ওপর; জিয়ার বিএনপি এবং বেগম জিয়ার বিএনপি। এরশাদীয় শাসনও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ প্রতিবারই বিকল্প চেয়েছে, নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে। ফলাফল কী? ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে এসে বিএনপি সরকার এবং ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জিতে আওয়ামী লীগ সরকারের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের ব্যর্থতায় কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।
আগেই বলেছি, গ্রহণযোগ্য ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিএনপির দুটি শাসন এবং আওয়ামী লীগের দুটি শাসনে বড় পার্থক্য নেই। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ এসব দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পড়েছিল। যেমন উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির সয়লাব, ব্যাংক হজম করে ঋণখেলাপি বৃদ্ধি, বিরোধী নিপীড়নের মামলা ও গ্রেফতার, দলীয় দৌরাত্ম্য এবং চাঁদাবাজির প্রসার, কবরস্থান থেকে শৌচালয় সর্বত্র দলীয়করণ, সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র হনন, প্রশাসন-পুলিশ-শিক্ষকদের দলদাসে রূপান্তর, ব্যবসাকে দলীয়করণ, পরপর তিনটি ভোটবিহীন নির্বাচন, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার অতি দম্ভ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, চরম বেকারত্ব, স্বাধীনতার চেতনাকে সরলীকরণ, বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগিকরণ-এর অনেকটাই আবার বিএনপির আমলেও ছিল। বিএনপি শুরু করেছে, আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সেটাকে চূড়ান্ত করেছে।
কোটার আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক মৃত্যু একাধিকক্রমে চতুর্থবারে ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও দ্রোহকে থুথুতে পরিণত করা গেলে আওয়ামী লীগের সবাই ভেসে সমুদ্রেই চলে যেত। আগস্ট বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগের অবস্থা কী? পূর্ণাঙ্গ শক্তিতে ফিরতে কি আবার একুশ বছর? বিশাল এ প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। কিন্তু বিএনপি তো আছে! অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা ফিরে এসেছে। রাধা নাচে। সবসময় কি? কখনো ন’মন চিনি-ঘি-ও দরকার হয়। এবারের সরকার এসেছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’কে ভর করে। সংবিধানে বর্ণিত একশত আশি দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কাছে পাত্তা পাবে কি? বিএনপি ইতোমধ্যেই সংবিধানে বর্ণিত সময়ে নির্বাচন দাবি করেছে আর এ দাবিটি সরকারবিহীন দেশে। কার কাছে দাবিটি? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে দাবি উঠেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার করেই নির্বাচন। ফলে বিএনপি আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি যুযুধান আগাম প্রতিভাত। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা একটি নতুন দলের ইঙ্গিত করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের একটি সাক্ষাৎকারে এমন একটি আভাস আছে বলে জানা যায়। ছাত্ররা কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারই চায় না; কোনো দলের ওপরই তাদের আস্থা নেই। তাদের দাবির মান্যতা দেওয়ার দরকার আছে-তারা তো তিন বছর এ সরকারব্যবস্থা রাখতে চায়। দেশের মানুষের আবার পুরোনো তিন দলে আস্থা কম। তাহলে এ সময়ের মধ্যে কি নতুন কোনো দল এসে শূন্য স্থান পূরণ করবে? কারা সেই দলের নেতৃত্ব দেবে? আর সেই দলে ছোট ছোট একাধিক রাজনৈতিক দল লীন হয়ে যাবে কি? আবার এ নতুন দল গঠনে বহিঃশক্তি সম্পৃক্ত হয়ে পড়বে কি? প্রশ্ন আছে, জিয়া-এরশাদের মতো ক্ষমতার শিখরে বসেই কি কেউ একজন নতুন দল গড়বেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাজনীতির আগামীকাল।
মোহাম্মদ আবদুল মাননান : অতিরিক্ত সচিব (অব.) ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার