শোক, বিশেষ করে মৃত্যুশোক, প্রাণিজগতের অনুভব। মৃত্যুশোক ছাড়াও আরও অনেক শোক আছে, কিন্তু বাইশে শ্রাবণ বারবার আমাদের এ চরম শোকের ঘাটেই পৌঁছে দেয়। জড়ের, যতদূর অনুমান করি আর জানি, কোনো শোক নেই। শোক একটি অনুভব; অনুভূতি না থাকলে শোক হয় না। জড়ের কোনো অনুভূতি নেই, তাই শোকও নেই। প্রাণীগুলোর মধ্যেও যদি ধরি, উদ্ভিদের কি কোনো শোক আছে?
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আমাদের একভাবে হয়তো বুঝিয়েছিলেন যে আছে-শোক, আনন্দ দুই-ই আছে। এ নিয়ে মার্কিন দেশে আমি একটি বইও পেয়েছিলাম আর পড়েছিলাম, মার্কিন গবেষক-সাংবাদিক পিটার টমকিন্সের লেখা ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব প্ল্যান্টস’ নামে। তাতে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার সশ্রদ্ধ উল্লেখ ছিল। গবেষকরা হয়তো উদ্ভিদজগতের শোকের চিহ্ন উদ্ধার করতে পারেন, কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের চর্মচক্ষে সেটা ধরা পড়ে না।
মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর শোক কেমন? আমি প্রাণিতত্ত্ববিদ নই, কিন্তু সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সব প্রাণীর শোক একরকম নয়। ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’ বলে একটা প্রবচন আছে বাংলায়। যার অজস্র সম্ভাব্য সন্তান, ডিম ফুটে মূর্ত হলেও তাদের সন্ধান রাখাও যার পক্ষে দুঃসাধ্য, তার শোকের প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদের? ঘরের বিড়ালদের? কাক ও অন্যান্য পাখির? একটি কাকের মৃত্যু হলে অনেক কাক জড়ো হয় এমন দৃশ্য দেখা আছে, কিন্তু কতটা তার ঘনত্ব, বিস্তার আর স্থায়িত্ব, তা আমি জানি না। হয়তো অন্যরা জানেন। যারা যূথবদ্ধ প্রাণী, তাদের শোক এক, যারা অযূথবদ্ধ, তাদের শোকের চরিত্র হয়তো আলাদা। পুরুষ বাঘ বা বিড়াল তো তাদের সন্তানদের খেয়েই ফেলে বলে জানি। হাতিদের শোকের একটি তথ্যচিত্র আমি দেখেছিলাম, তা আমার ‘মৃত্যু, জীবনের প্রথম পাঠ’ বইয়ে আমি লিখেছি।
আফ্রিকার জঙ্গলে বৃদ্ধ সরদার হাতিরা মৃত্যু অনিবার্য ও আসন্ন তা টের পেলে কাছের নদীর ধারে একটি প্রশস্ত স্থানে গিয়ে শুয়ে পড়ে, মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকে, একসময় মারাও যায়। সে জায়গাটা মৃত হাতিদের সাদা কংকালের স্তূপে ভরে ওঠে। আমরা দেখেছিলাম একটি বৃদ্ধ হাতি এভাবে মৃত্যুর জন্য ওই উপত্যকার দিকে মন্থরগতিতে হেঁটে আসছে। কিন্তু সে একা নয়। তার পেছনে তার গোটা দল, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটি হাতির এক মিছিল। শব্দহীন শান্ত পদক্ষেপে তার পেছন পেছন আসছে তাকে শেষ বিদায় জানাতে। সে দলে শিশুরাও আছে, তাদের মধ্যেও কোনো চপলতা নেই।
শেষ পাহাড়ের ওপারে সেই নদী-উপত্যকা, সেখানে এসে বৃদ্ধ হাতিটি থেমে গেল। গোটা দলও থেমে গেল। বৃদ্ধ হাতিটি শুঁড় দিয়ে কাছের দু-একটি হাতিকে স্পর্শ করল, যেন বলল, ‘এবার আমার একার যাওয়ার পালা। তোমরা ফিরে যাও।’ দল দাঁড়িয়ে রইল, হাতিটি একা একা এগিয়ে গিয়ে সেই সাদা কংকালগুলোর পাশে একটা জায়গা দেখে শুয়ে পড়ল। বাকি হাতিদের কয়েকটির চোখে আমি যেন জলও দেখলাম। মানবেতর প্রাণীর ক্ষেত্রে এই একটি শোকের বিশদ দৃশ্যই আমি দেখেছি, প্রাণ হাতে করে সে তথ্যচিত্র নির্মাতারা সেটি তুলেছিলেন বলে। হয়তো পাঠকদের কাছে অন্য প্রাণীদের শোকযাপনেরও খবর আছে।
২.
মানুষের শোক আরও অনেক জটিল এক বিষয়। তার একদিকে আছে অনুভব ও তার মাত্রা বা ঘনত্ব, অন্যদিকে আছে তার প্রকাশ। শোকের অনুভব, তার মাত্রা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে যার মৃত্যুতে শোক, সে আমার কতটা নিকটজন, কিংবা নিকটজন বলে অনুভব করেছি। না, অনাত্মীয়, দূরের মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোক অনুভব করি না, তা নয়। ফিলিস্তিনে শিশুদের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত হই, কিন্তু তা কতটা ‘স্থায়ী’ হয়, এ স্থায়িত্বের চিহ্ন কী কী, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। শোক স্থায়ী হয় তার ঘনত্ব ও গভীরতার ওপর। এর একটা সাক্ষাৎ সম্পর্ক হয়তো আছে, যার মৃত্যু হলো সে আমার কত কাছের। এ ‘কাছের’ কথাটারও নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। সে আমার সন্তান? স্বামী বা স্ত্রী? পরিবারের অন্য সদস্য? বন্ধু? অন্য কোনোভাবে প্রিয় যেমন-দেশনেতা বা চলচ্চিত্রের নায়ক বা নায়িকা? মানুষের বাইরে হলে, আমার পোষা প্রাণী? এ রকম প্রিয়তার যা নানা বৃত্ত আছে, সে তার কেন্দ্রের কতটা কাছাকাছি?
প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনা ও অঘটনে মৃত্যুর খবর আমরা দেখি, শুনি বা পড়ি। তা নিয়ে আমরা যা অনুভব করি, তা কি শোক না সহানুভূতি? আত্মতা বা ‘মমতা’ থেকে দূরত্ব একটা মাত্রা, সংবাদবাহিত সব শোক আমরা সমানভাবে অনুভব করি না, হয়তো কখনো বিষণ্ন হই মাত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’র ছত্র মনে পড়ে, ‘মাথায় পড়িলে লোকে বলে, বজ্র বটে’-যদিও কথাটা কৌতুক করার মতো নয়। সন্তান, স্বামী, দয়িতা, পিতা, মাতা, পরিবার ও অন্যান্য সূত্রে আরও কত কাছের মানুষ চলে যায়, অকালে, পূর্ণকালে, জীবন থেকে হারিয়ে যায় অজস্র প্রিয় অস্তিত্ব। আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি।
সবাই কি? অনুভবের এ হিসাব নিতে গিয়ে দেখি, শিশুরা মৃত্যুশোক ঠিক উপলব্ধি করতে পারে না। কত বয়স পর্যন্ত পারে না? মৃত্যু যে চিরকালের জন্য হারানো, তা কি তারা বোঝে? তারা প্রশ্ন করলে আমরা স্তোক দিই যে, অমুকে আকাশের তারা হয়ে গেল, তাতে তারা কী সান্ত্বনা পায় কে জানে? শোক সম্ভবত তাই বয়স্ক মানুষের অনুভব।
তবু মানুষের সংসারে এ শোকের ভিত্তি নিয়েই কত প্রশ্ন উঠে পড়ে। প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি, দ্রুত সম্পত্তি দখল করার লোভে সন্তান মা বা বাবাকে ফেলে যাচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে, এমনকি নৃশংসভাবে হত্যা করছে। কাগজে দেখলাম একটি মেয়ে তার নাবালক প্রেমিককে অনুমোদন না করায় তার মাকে দুজনে মিলে হত্যা করেছে কলকাতার বেহালায়। তার বাবার চোখের সামনে, বাবাকেও খুনের হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল। তার শোকের অনুভব কোথায় ছিল? লোভ আর কামনার তীব্রতা কখন, কাদের ক্ষেত্রে রক্তের বন্ধনকে তুচ্ছ করে এ অদম্য হিংস্রতা জাগিয়ে তোলে? কে জানে?
অনুভব যেমন, তেমনই শোকের প্রকাশের ব্যাপারটাও জটিল ও প্রশ্নসংকুল। কেউ স্তব্ধ ও শান্ত স্থৈর্যে আসীন থাকেন, রবীন্দ্রনাথেরই মতো, যাকে কখনো নিষ্ঠুরও মনে হয়, আবার কেউ বুক চাপড়ে, চিৎকার করে, মাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে শোককে প্রচার করেন। আবার কেউ কান্নার লোক বা ‘রুদালি’ ভাড়া করে আনেন টাকা দিয়ে, শোকের বাণিজ্যকরণের আশ্রয় নেন। প্রিয়জনের হত্যাকারীদের শোকের চরিত্রটাই বা কী রকম?
শোক একটা বিচিত্র ও সংকটময় সমস্যা বটে। তার সম্ভাবনা, ঘনত্ব, স্থায়িত্ব, প্রকাশ-সবকিছু নিয়েই কত প্রশ্ন উঠে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ, আপনার মৃত্যুদিনকে সূত্র করে এ প্রশ্নগুলো তুলছি বলে আমাদের ক্ষমা করুন। আপনার নিজের শোকযাপন থেকে আমরা কতটা কী শিখতে পেরেছি জানি না।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা