কোটা আন্দোলন ও মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা
মো. আনছার আলী খান
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বুধবার ছিল সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’। নতুন প্রজন্মের আন্দোলনে বৈচিত্র্য আছে বৈকি। হরতাল, ধর্মঘট এসব পুরোনো ধ্যান-ধারণার আন্দোলন সাধারণ মানুষকে আর টানে বলে মনে হয় না। তাই এসব আন্দোলনের ঘোষণায়ও রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম থেমে থাকতে দেখা যায় না ইদানীংকালে।
তবে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে বহু কষ্টে কেনা গাড়িটি রাস্তায় বের করার সাহস হয়নি। আমার মতো অনেককেই যে সিএনজি নিয়ে রাস্তায় বেরোতে হয়েছে, তা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। রাস্তায় পিকেটিং না থাকায় অতি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দিয়েই খুব সহজেই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
এভাবে সারাটা দিন পার হলে ‘বাংলা ব্লকেড’ও অন্যান্য হরতাল, ধর্মঘটের মতো গুরুত্বহীন কর্মসূচিতে পরিণত হবে। দাবি আদায়ের সব কর্মসূচি একে একে নির্জীব হয়ে পড়ার বিষয়টি সচেতন মহল অবশ্যই কামনা করে না। তাতে শাসকগোষ্ঠী অবচেতন মনেই চরম কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে, যা দেশ ও জনগণের জন্য কোনো শুভ বার্তা নয়।
মূল কথা অর্থাৎ কোটা সংস্কারের প্রসঙ্গটিই আজকের প্রাসঙ্গিক বিষয়। ২০১৮ সালে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলনের মুখে সব কোটা বাতিল করে নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তবে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী প্রথম সারির কোনো নেতা তাদের মেধার প্রমাণ দিতে বিসিএস বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সাহস দেখিয়েছেন কিনা তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং এরূপ কোনো কোনো নেতার মিথ্যা চাপাবাজি দেশবাসী, এমনকি তার ত্যাগী কর্মীরাও অতি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছেন।
চাপাবাজির মাধ্যমে জাতীয় নেতার লেবাস পরে যদি কোনোভাবে এমপি, মন্ত্রী হওয়া যায়, তাহলে এত কষ্ট করে কেন বিসিএস পরীক্ষা! যারা এ পরীক্ষায় বারবার সব ধাপ অতিক্রম করেও কোনো চাকরিই পান না, এমনকি পছন্দমতো ক্যাডার না পেয়ে ননক্যাডার বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি পান, তাদের কষ্টের বিষয়টি অনুধাবন করেই হয়তো অনেকে এ সাহস দেখান না। যদি বলা হয় ধরা খাওয়ার ভয়েই-তাহলে নিশ্চয় বেশি বলা হবে না।
মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, জেলা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি, এমন নানা শ্রেণির জন্য কোটাব্যবস্থা চালু থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা শোনা যায়। এর কয়েকটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, মোট কোটার সর্বাধিক সংখ্যা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের সুযোগদান। এ কোটায় যখন মুক্তিযোদ্ধা স্বয়ং, এমনকি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা সুযোগ পেয়েছেন, তখন এর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হয়নি।
পাকিস্তান আমলে যখন মেধাবীর আইকন হিসাবে খ্যাত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে বাঙালিরা সুযোগ পেয়েছেন, তখনো পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ কোটার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। তাহলে এখন কেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকারবিরুদ্ধ আন্দোলন বলে রং দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের অবস্থান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হওয়ার কারণেই সরকার থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের দাবিও কোটার বিরুদ্ধে। তাহলে বলতে হবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের একাত্মতা ঘোষণার অঙ্ক মেলানো বড়ই কঠিন। দেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হাজারও ইস্যু বিদ্যমান। এতদসত্ত্বেও কেবল ছাত্রদের আন্দোলনের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে জনগণের প্রত্যাশিত সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কিনা, তা হাজার বার ভেবে দেখার বিষয়।
ছাত্রদের চলমান আন্দোলনের এ সময় কিছু একটা বলা বা লেখা দরকার বলেই হয়তো স্বনামধন্য অনেকেই অনেক কিছু বলছেন বা লিখছেন। নানা কারণেই আমি লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। তবে আজ একজন খ্যাতনামা কলামিস্টের লেখায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার বিশ্লেষণ দেখে কলম তুলে নেওয়া। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে ঘোষিত বিধায় মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়।
তাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ইস্যুতে যে যার মতো ব্যাখ্যা প্রদান করবেন, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই হয়তো মুক্তিযোদ্ধা সুরক্ষা আইন বর্তমানে যুগের দাবি হয়ে উঠেছে। স্বনামধন্যের সে লেখায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানকারী, সহায়তাকারী, খাবার সরবরাহকারী, হানাদার কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, সবাইকে একইভাবে ওজন করা হয়েছে বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান। তিনি ঠিকই লিখেছেন কোনো কিছু পাওয়া জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যাননি।
তবে মুক্তিযুদ্ধ করে যারা সনদ নেননি, তাদের সঙ্গে সনদ গ্রহণকারীদের অসম্মান না করেও চমৎকার একটি লেখা উপহার দেওয়ার মতো যোগ্যতা তার রয়েছে বলে বিশ্বাস করি। আমার বিবেচনাতেও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল, সেহেতু গুটিকয়েক চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর বাদে সাড়ে কোটি বাঙালির অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাই বলে সম্মুখযোদ্ধার সঙ্গে অন্যদের তুলনা কি খুবই প্রয়োজন?
অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন আমিও। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মাসিক ৫০ টাকা ভাতা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দীর্ঘজীবনে কোনোরূপ সুযোগ আসেনি। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের সুযোগসহ কোটা সুবিধা এবং সবশেষে ১ বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। কারণ এ সুযোগটি না পেলে আমি এই ’আমি’ হতে পারতাম না। এ সুযোগ না পেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ আমি পেতাম না।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েও চাকরিকালীন বিভিন্ন পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণে আমার মেধার যথাসম্ভব স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছি। সুদীর্ঘ চাকরিজীবনের বার্ষিক মূল্যায়নে অসাধারণ কর্মকর্তা হিসাবে মূল্যায়িত হয়েছি। সরকারের নীতিনির্র্ধারণীতে আমার ভূমিকা সবসময় প্রশংসিত হয়েছে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদের দায়িত্ব পালনে সেবা গ্রহণকারীদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছি। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে জবাবদিহির মাধ্যমে আমার সীমাবদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিত্যদিন প্রচারিত হয়েছে।
হাজারও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমার নিজ এলাকার প্রতি আমার দায়বদ্ধতা থেকে সবার আপনজন হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমার পরিবারকে সুখী ও সার্থক পরিবার হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছি। সর্বোপরি দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের অতি সম্মানজনক এক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি কি কেবল কোটা সুবিধায় চাকরিটা পাওয়ার কারণে? এ কাহন শুধুই আমার নয়।
মুক্তিযোদ্ধা বা বিভিন্ন কোটায় চাকরি পাওয়া অনেকেই আমার চেয়েও অনেক প্রশংসার দাবিদার হয়েছেন। পাকিস্তানি আমলে বাঙালি কোটায় চাকরি পাওয়া যদি অন্যায্য না হয়ে থাকে, তবে অন্যান্য কোটার ক্ষেত্রে কেন এত বিশ্লেষণ!
এখন আসি মেধার কথায়। গত কয়েকটি বিসিএসে তো কোনো কোটা নেই। তাহলে এখন কেন দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রার্থীদের ডিঙিয়ে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছে? আসলে মেধা যাচাইয়ের সঠিক ও প্রকৃত প্রক্রিয়া এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই অনেক মেধাবী প্রার্থী যাচাইয়ের প্রাথমিক স্তরেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। এ লজ্জা থেকে বাঁচতে অনেক মেধাবী এ প্রতিযোগিতাই এড়িয়ে চলে। আর তাই বিদেশে লেখাপড়া শেষে সেসব স্থানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কোটা সুবিধার কারণে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে বলে অভিজ্ঞজনদের যে বক্তব্য, তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন।
একটি বিষয় আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেন কোনোভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ দেশ মাত্র ৯ মাসে স্বাধীন হয়ে যাবে এটা ভেবে কেউ যুদ্ধে যাননি। বিকল্প অনেক অপশনের মধ্যে জীবন বাজি রেখে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তারা এখনো কিছুই চান না, শুধু আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চান। ক্রমেই তাদের সংখ্যা কমে আসছে।
স্বাধীনতার এতদিন পর তাদের পরিচিতি নিয়ে কেউ বিচার বিশ্লেষণে মেতে উঠুক, এটা তারা দেখতে বা শুনতে চান না। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে ঘোষণা দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে না। তা রক্ষা করার দায়িত্ব যেহেতু রাষ্ট্রের, সেহেতু ‘মুক্তিযোদ্ধা সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
মো. আনছার আলী খান : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব