Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সর্বজনীন পেনশন কি সর্বজনের হতে পারছে?

Icon

সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সর্বজনীন পেনশন কি সর্বজনের হতে পারছে?

সর্বজনীন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি সবার মঙ্গল বা সবার হিত বা কল্যাণ বা সবার মঙ্গলের জন্য কৃত বা সবার জন্য উদ্দিষ্ট। সর্বজনীন পেনশনও সবার মঙ্গলের জন্যই হবে এবং সরকারের উদ্দেশ্যও তাই। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় হয়তো সরকার সবাইকে পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু তারপরও এমন কিছু স্কিম রাখা উচিত ছিল, যেখানে আইএলও’র নীতি অনুযায়ী যারা চাঁদা দিতে অক্ষম, তাদেরও এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের পক্ষে চাঁদা প্রদান করে সর্বজনীন পেনশনে অংশগ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব, সেজন্য এ বিশাল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা হতদরিদ্র, তাদের জন্য তেমন কোনো ঘোষণা নেই। তাই সর্বজনীন হয়ে উঠতে সরকারকে আরও উদারতা দেখাতে হবে। ১০ কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনার লক্ষ্য ধরে দেশে বহুল প্রত্যাশিত সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ধীরগতির কারণে সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর বাস্তবতা এখন শুধু দীর্ঘসূত্রতার দিকেই গড়াচ্ছে। এতে দেখা গেছে, মাত্র এক লাখ নিবন্ধন পেরোতেই ৯ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের। সর্বশেষ তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩২১ জনের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এক বছরের এ সংখ্যাটা খুব সামান্য, লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ০.১ শতাংশ। এতে মোট জমা হয়েছে ৫২ কোটি ৩৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা।

গত বছর ১৭ আগস্ট দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রথমেই চারটি স্কিম-প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নাম দিয়ে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হয়। পরে সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামে আরও একটি নতুন স্কিম খোলা হয়, যা আগামী জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বলা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানে সদ্য যোগদান করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে পেনশন স্কিমের আওতায় আনা হবে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এ বিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে যুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে করণীয় সব ধরনের উদ্যোগও রয়েছে সরকারের। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে সরকার উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নতুন এ পেনশনব্যবস্থা হাতে নিয়েছে; কিন্তু বাস্তবক্ষেত্র তা জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। আইএলওর পেনশন নিয়ে যে নীতিমালা দেওয়া আছে, সেখানে সর্বজনীন পেনশনের জন্য সব নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির জন্য বলা হয়েছে, মূলত যারা নিুআয়ের ও সরকারকে পেনশনের জন্য টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই, সেসব মানুষকেও পেনশনের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা থাইল্যান্ড, ব্রুনাইসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে অনুসরণ করছে।

এবার একটি সংবাদের দিকে নজর দেওয়া যাক, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আসছেন রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বায়ত্তশাসিত ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগামী ১ জুলাই বা তার পর এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সুবিধার আওতায় আসবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৪-এর উপ-ধারা (২)-এর শর্তাংশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এর অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী রয়েছেন, তারা যে নামেই অভিহিত হোন না কেন, তারা এবং ১ জুলাই ও তার পর নতুন যারা যোগদান করবেন, তাদেরও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করল। অর্থাৎ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থাৎ ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রামসহ ৫০-এরও অধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জুট মিল, বিএডিসি, বিভিন্ন গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো, বিটিসিএলসহ প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠান এই কর্মসূচির আওতায় পড়বে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা কার্যকর হবে। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ নীতিমালাকে বাস্তবায়ন না করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে। শিক্ষকরা মনে করেন, ১ জুলাই থেকে যোগদানকৃতদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা বৈষম্যমূলক। এ ধরনের বৈষম্য বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে শিক্ষাদর্শনের চেতনা থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন, এ প্রজ্ঞাপন সেই চেতনাকে অবজ্ঞা ও অবমাননা করার শামিল।

শিক্ষকরা মনে করেন, বৈষম্যমূলক এ পরিকল্পনা বাতিল করা হবে। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। এটি কার্যকর করা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং আগামীতে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন। এ নিয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সরব এবং অনতিবিলম্বে তা বাতিল না হলে সব বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখন হয়তো একটা অংশ মনে করতেই পারেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিছু হলে আন্দোলনের হুমকি দেয়, এ আর নতুন কী? কিন্তু প্রতিনিয়ত যখন এ পেশায় সুযোগ-সুবিধা কমানো হচ্ছে, নতুন নতুন নিয়মের শিকলে বন্দি করা হচ্ছে, তা দেখে সহজেই অনুমেয় যে, দেশের মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ হারাবেন। এমনিতেই গত এক দশকে সরকারি চাকরিতে যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ করে প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে বাড়ানো হয়েছে, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে। আগের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যে সুবিধা পেত, হিসাব-নিকাশ দেখা যায় বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় তা অনেক কম ও সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় আরও কম। স্বাভাবিকভাবেই আগে থেকে কোনো সুবিধা যদি নতুন করে না দিয়ে কমিয়ে ফেলা হয়, তাহলে এটা কেউই মানবেন না। নতুন প্রজন্মের যারা এসব প্রতিষ্ঠানে আসবেন, হয়তো প্রথমে না জেনে-বুঝে আসবেন, কিন্তু পরে হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। এছাড়া বর্তমানে যারা কর্মরত; তারাও যদি নতুন করে শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ পান, তারাও সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসবেন। স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান সুবিধা বজায় রেখে তাদের এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, সেসঙ্গে সরকারি সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, না হলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, যে মাঠপ্রশাসন স্কিম নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করছে এবং তার সুবিধা তুলে ধরছে, তারাও কিন্তু এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন। যেহেতু সর্বজনীন পেনশন, সেহেতু সবার অংশগ্রহণে এবং সবার কল্যাণের জন্যই এ ব্যবস্থা হতে হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের বিদ্যমান পেনশন কাঠামো ঠিক রেখে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে আর যাই হোক মঙ্গল হবে না।

বর্তমান স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যদি ৩০ বছর চাকরিকাল পূর্ণ করে ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন এবং অবসরকালে মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা হয়, তাহলে বর্তমান পেনশনের সঙ্গে সর্বজনীন পেনশনের যে বৈষম্য, তা তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান নিয়মে একজন শিক্ষক চাকরির ৩০ বছর পূর্ণ করে অবসর গ্রহণ করলে এককালীন ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মতো পাবেন এবং এলপিআরে থাকাকালীন প্রতি মাসে ৭৮ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এক বছর প্রাপ্য হবেন; এছাড়া এলপিআরের সময় শেষ হওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩৭ হাজার টাকা করে প্রাপ্য হবেন, এবং মৃত্যুর পর স্ত্রীও একই সুবিধা পেয়ে থাকবেন। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অবসরের পর প্রতি মাসে ১,২৪,৬৬০ টাকা পাবেন, কোনো বোনাস পাবেন না। আর এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করলে ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্ত্রী পেনশন পেয়ে থাকবেন। তাই সহজেই অনুমেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আগের চেয়েও কমে যাবে। তাই সরকারের প্রতি শিক্ষক সমাজের অনুরোধ থাকবে বিষয়টি বিবেচনা করার।

সাইফুল ইসলাম : প্রভাষক, লোক প্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

saiful@pad.brur.ac.bd

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম