Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রিজার্ভ ঘিরে অস্বস্তি কাটানো সহজ নয়

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আইএমএফের যে ঋণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ রয়েছে, তার তৃতীয় কিস্তিটাও পাওয়া গিয়েছিল। এটা আবার পরিমাণে ছিল প্রতিশ্রুতির প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। ডলারে বেশি করে প্রাপ্তি বাংলাদেশ সরকারের জন্য এ মুহূর্তে জরুরি বৈকি। কেননা বিদেশি মুদ্রা তথা ডলারের বড় সংকটে আছে দেশ। আরেকটি নতুন অর্থবছরে ঢুকে পড়েছি; কিন্তু চলে আসা ডলার সংকট আমাদের ছাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য মোট রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়ে দেখিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, পরিস্থিতি আছে নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যবহারযোগ্য তথা নিট রিজার্ভ যে সংকটেই রয়েছে, সেটা আড়াল করা যাচ্ছে না।

মূলত ডলার সংকটে পড়ে আইএমএফের সহায়তা গ্রহণের কারণেও নিট রিজার্ভ জানা হয়ে যাচ্ছে আমাদের। কেননা সংস্থাটি ঋণের কিস্তি অনুমোদনের সময় নিট রিজার্ভকে একটা স্তরে রাখার শর্ত দিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে সেটা করতে হচ্ছে পালন। না পারলে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। এ ঋণ কর্মসূচিতে আইএমএফের আরও কিছু শর্ত অবশ্য রয়েছে। এর কিছু প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছি নতুন বাজেটেও। যেমন, কর অব্যাহতি থেকে বেরুতে চাওয়া। সেটা পুরোপুরি না পারলেও সরকার এ ধারায় প্রবেশ করেছে। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসায়ও জোর দিচ্ছে আইএমএফ। সরকার দেরিতে হলেও এটাকে গ্রহণ করেছে নীতি হিসাবে। এর আওতায় বিদ্যুতের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানোর কর্মপন্থা নিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম করা হয়েছে ‘বাজারভিত্তিক’।

আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি সম্পর্কিত আলোচনা চলাকালে আর্থিক খাতের বড় দুটি সংস্কারেও প্রবেশ করেছে সরকার। এক. ব্যাংকঋণের সুদের হার থেকে ‘ক্যাপ’ উঠিয়ে দিয়ে একে বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ। দুই. মুদ্রার বিনিময় হারকেও বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ। তাতে এরই মধ্যে ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রার বড় অবমূল্যায়ন ঘটেছে; ঘুরিয়ে বললে, ডলারের ‘আনুষ্ঠানিক দাম’ গেছে বেড়ে। ডলারের দামে রাতারাতি ৭ টাকা বৃদ্ধির ঘটনা এরই মধ্যে দেখতে হয়েছে। এর ভালো-মন্দ নিয়েও চলছে আলোচনা। এর মধ্যে এ কথাটা বারবারই বলা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুদের হার বা ডলারের দাম কোনোটাই আটকে রাখা উচিত হয়নি। বছরের পর বছর এটা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও অনুচিত। তাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও না হয় কথা ছিল। এটাও তো পরিষ্কার যে, ডলার বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ছিল বিরাট। এতে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ বেড়ে উঠেছে; রপ্তানি আয় দেশে না আনার প্রবণতাও বেড়েছে অনেক। করোনা পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা ডলারের মজুত তথা রিজার্ভ ক্ষয়ও রোধ করা যায়নি।

রিজার্ভ ক্ষয় হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারকে যেতে হয়েছে আমদানি নিয়ন্ত্রণে। ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর একটা দেশ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করলে তার হাতে থাকা ডলারের ওপর চাপ হয়তো কমে; কিন্তু প্রবৃদ্ধি যায় সংকুচিত হয়ে। আমদানি নিয়ন্ত্রিত হলে এর রপ্তানি খাতের বিকাশও হয় ব্যাহত। দেশটি তো এমন একটি রপ্তানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে, যা উৎপাদন করতে হয় ব্যাপকভাবে কাঁচামাল আমদানি করে। গেল অর্থবছরে এ খাতে (তৈরি পোশাক) ৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক কিছুই দায়ী; তবে ডলার সংকটের ভূমিকাও স্বীকার করতে হবে। খাদ্যপণ্য আমদানিও হ্রাস পেয়েছে বিগত অর্থবছরে। চাল ছাড়া বলতে গেলে সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যই কিন্তু আমদানি করতে হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। বেড়ে গিয়েছিল সার, ডিজেল ও এলএনজির মতো পণ্যের দাম। এসবও বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। অন্যান্য পণ্যের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে হলেও এগুলোর আমদানি রাখতে হয়েছে সচল।

তাতেও কিন্তু ধাপে ধাপে দেখা দিয়েছে সংকট; জমে উঠেছে বকেয়া। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম ধীরে ধীরে কমে এলেও ডলার সংকট অব্যাহত থাকায় আমরা পারিনি আমদানি বাড়িয়ে এর সুফল নিতে। ডলারের দাম বাড়তে থাকায় আমদানি ব্যয় কমানো যায়নি খাদ্যপণ্যেও। তাতে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনেও এগোতে পারেনি সরকার। গেল অর্থবছরে এক্ষেত্রে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। নতুন অর্থবছরেও এটাকে বলা হচ্ছে সরকারের ‘প্রধান লক্ষ্য’। মূল্যস্ফীতির জন্য অনেক কিছুই দায়ী; তবে একটা আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে ডলার সংকটের দায়কে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা যায় না। নতুন পদ্ধতিতে ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানোর আগেও আমদানিকারকদের এ দামেই কিংবা এর চেয়েও বেশিতে ডলার কিনে বিল মেটাতে হতো। ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দামের ব্যবধান কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংক এখনো বেশি দামে ডলার কিনছে এবং সে কারণে আরও বেশি দামে তা করছে বিক্রি।

ডলারের দাম বাজারের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টায় অবশ্য ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। গত মে ও জুন মাসে বিপুলভাবে বেড়েছে এটা। কুরবানির ঈদের কারণেও এটা ত্বরান্বিত হয়ে থাকতে পারে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নতুন করে সংকট উপস্থিত হলেও সামগ্রিকভাবে কর্মী প্রেরণ হালে এত বেড়েছে যে, দেশে রেমিট্যান্স বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনো ৫০ শতাংশ কিংবা এরও বেশি রেমিট্যান্স আসছে হুন্ডিতে। বহু রেমিট্যান্স প্রাপক এতে অভ্যস্তও হয়ে পড়েছে। শুধু ডলারের দাম বাড়িয়ে এবং সঙ্গে কিছু প্রণোদনা দিয়ে এ ব্যবস্থা ভাঙা যাবে বলে মনে হয় না। আরও অনেক কিছু করতে হবে। ব্যাপকভাবে রেমিট্যান্স প্রাপক দেশগুলো কীভাবে এ সমস্যা মোকাবিলা করছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। নতুন অর্থবছরে রপ্তানি আয় কতটা বাড়ানো যাবে, তার পাশাপাশি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রায়ও জোর থাকা প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগ বিপুলভাবে বাড়ানোর সুযোগ তো আমাদের নেই। গেল অর্থবছরে এক্ষেত্রে ‘পারফরম্যান্স’ আরও খারাপ বলতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহী না দেখলে বিদেশিরা কেন একটা দেশে বিনিয়োগ করতে আসবে, এটা পুরোনো প্রশ্ন। নতুন করে দেখার বিষয়, যারা ইতোমধ্যে এখানে ব্যবসায় নিয়োজিত-চলমান ডলার সংকটে তারা লভ্যাংশ নিতে পারছে না দেশে! বিদেশি বিনিয়োগে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটির কূটনীতিককেও এখানে এসে এ বিষয়ে কথা বলতে দেখা গেল। এ অবস্থায় দেশে তাদের পুনঃবিনিয়োগ বাড়লেও নতুন করে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা কমই। এর মধ্যে আবার এনবিআর চেয়েছিল বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর-শুল্ক অরোপ করে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে! প্রতিশ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ আটকে যাওয়ার শঙ্কায় সে উদ্যোগ অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে।

ডলার সংকট কাটাতে তেমন অনুদান পাচ্ছি না এবং পাবও না আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা আর দরিদ্র বলে বিবেচিত নই বলে। এলডিসি উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আমরা রয়েছি আর তা প্রচারও করছি। সেটি বাস্তবে ঘটার আগপর্যন্ত আমরা অবশ্য সহজ শর্তে বিদেশি ঋণসহায়তা পাব। সে চেষ্টাই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বেশি করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রধানত বিদেশি ঋণে। চীন, রাশিয়ার মতো অপ্রচলিত উৎস থেকেও ঋণ নিচ্ছে সরকার। এগুলো সাধারণভাবে স্বল্পমেয়াদি বলে কিছু ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হচ্ছে প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই। যেমন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর আগেই পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণ। তাতে আবার সংকট দেখা দিয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায়। এতে ঋণের দায় তথা সুদ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এদিকে সুদ বাবদ ব্যয় হয়ে উঠেছে বাজেটে সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের সর্ববৃহৎ খাত। এতে অবশ্য দেশের ভেতর থেকে নেওয়া ঋণের সুদও অন্তর্ভুক্ত। সরকার প্রত্যাশিত হারে রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থ বলেও তাকে সম্ভাব্য সব উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে বেশি করে। বিদেশি ঋণ কম পেলে আবার দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নিতে হচ্ছে বেশি করে।

গেল অর্থবছরে বিদেশি ঋণে প্রতিশ্রুতি ও ছাড় আগের মতো করে বাড়েনি বলে খবর রয়েছে। কিন্তু বেড়ে উঠেছে পুঞ্জীভূত ঋণ সুদাসলে পরিশোধের চাপ। এটা সামনে আরও বাড়বে বৈকি। সমস্যা হলো, ডলারে নেওয়া ঋণ শোধ করতে হচ্ছে ডলারে। সরকার তো ডলার ছাপিয়ে নিতে পারছে না! সংকটে পড়ে টাকা যেমন ছাপিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। মাঝে এটা বন্ধ হলেও অর্থবছরের শেষ সময়ে নাকি নতুন করে ছাপানো হয়েছে টাকা। এতে মূল্যস্ফীতিতে কী ‘গুণক প্রভাব’ পড়বে, সেটা বিবেচনারও সুযোগ বোধহয় নেই। তবে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি এডিপির অর্থ ব্যয়ের নামে অপচয় বন্ধ হলেই ভালো হতো। জোর করে এর ‘সন্তোষজনক বাস্তবায়ন’ দেখানোর প্রয়োজন তো নেই। দেশ যে বড় অর্থ সংকটে রয়েছে, সেটা স্বীকার করে চলাই ভালো।

সরকারের হাতে ডলার তেমন নেই; টাকাও নেই। তবে ডলার সংকটটাই বেশি। এত বেশি যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাও জরুরি পণ্য-যেমন জ্বালানি তেল আমদানি করতে গিয়ে পড়ছে ডলার সংকটে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তো বটেই; বাংলাদেশ ব্যাংকও তাকে পর্যাপ্ত ডলার জোগাতে রাজি হচ্ছিল না। কারণ বারবার ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইছিল অন্তত জুন শেষে নিট রিজার্ভটা আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাখতে। আর তাতে নাকি সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে সেটা প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়িয়ে নয়; বরং ঋণ করে। আইএমএফসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণসহায়তা পাওয়ায় নিট রিজার্ভ বেড়ে নির্ধারিত স্তর অতিক্রম করেছে বলেই জানা যাচ্ছে। এগুলোর সিংহভাগ আবার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। তাই সেটা যেমন নিট রিজার্ভে দেখানো যাচ্ছে, তেমনি এসব ঋণ পরিশোধেও মিলবে বাড়তি সময়। তবে এর ভেতর দিয়ে রিজার্ভ ঘিরে অস্বস্তি দূর হয়েছে বলা যাবে না। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বেশি হারে বাড়িয়ে এবং এটাকে সফলভাবে দেশে এনে ডলারকে সহজলভ্য করতে না পারলে তা নিয়ে অস্বস্তি কাটবে কীভাবে?

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম