Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতি কমানো কতটা সহজ হবে?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতি কমানো কতটা সহজ হবে?

জুন মাসের ৬ তারিখে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নতুন বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। ১৫ দিন গত হয়েছে। এরই মধ্যে যথাযোগ্য মর্যাদা ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পবিত্র ঈদুল আজহা। কুরবানির ঈদ। ঢাকা শহর বলা যায় এক রকম ফাঁকা। রাস্তাঘাট ইতোমধ্যেই বর্জ্যমুক্ত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গাড়ি-ঘোড়া কম। রিকশাও কম। এরই মধ্যে প্রচুরসংখ্যক রিকশা দেখা যাচ্ছে মেশিনচালিত। এসব কোনো প্রতিবন্ধীচালিত নয়। সুস্থ-সবল চালকরাই এসব চালাচ্ছে। মানুষও চড়ছে এসবে। কাঁচা বাজার নামমাত্র খোলা। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকানের অনেকই বন্ধ। বুধবার অফিস খুলেছে, ব্যাংক খুলেছে। এটাকে লোকেরা বলে কোলাকুলি দিবস। কারণ ঈদের ছুটির পর এদিন কোনো কাজ হয় না। আর অফিসে-ব্যাংকে কোনো কাজের চাপও নেই। সর্বত্রই স্বস্তি স্বস্তি ভাব। ঈদ উপলক্ষ্যে এক কোটিরও অধিক ঢাকাবাসী গ্রামে যায়। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উৎসব পালনের জন্য। বেশ আনন্দ। সঙ্গে যায় প্রচুর ‘ক্যাশ’-নগদ টাকা। এ টাকা রোজগারের টাকা, বেতনের টাকা, বোনাসের টাকা। আছে সঞ্চয়ের টাকাও। এর সঙ্গে যোগ হয় বরাবরের মতোই প্রবাসী আয়, যা পাঠায় বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা বাবা-মা, ভাই-বোনের কাছে। সব মিলে কত টাকা হবে? এর কোনো প্রকৃত হিসাব কেউ দিতে পারে না। তবে প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সের ডলার/টাকার একটা হিসাব পাওয়া যায়। এবার ঈদের আগে জুন মাসের ১৩ তারিখ ছিল ব্যাংকের শেষ কর্মদিবস। এ মাসের কয়দিনেই এক বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান সাত কোটি) ডলারের মতো রেমিট্যান্সের ডলার এসেছে বলে খবরে দেখেছি। শত কোটি ডলার মানে হচ্ছে ১২০ টাকা করে ১২ হাজার কোটি টাকা। বেশ ভালো টাকা যদিও তা সারা দেশের সব অঞ্চল পায়নি। পেয়েছে যেসব অঞ্চলের লোক বিদেশে আছে, তারা। কত টাকা ঈদুল ফিতর, কুরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে ব্যয় হয়, তার হিসাবও কারও কাছে নেই। সবই অনুমান। অনুমানটি একটু নির্ভরযোগ্য করা যায়, কুরবানির পশু বিক্রির হিসাব দিয়ে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল এবার পশুর হাটের অবস্থা ভালো নয়। পশু আমাদের প্রচুর। সরকারি মতে আমরা উদ্বৃত্ত। গত ১৫ বছরে গবাদি পশুর উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে তা ৭ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছেছে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশ দুটি থেকে প্রচুর পশু এসেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব পশু কীভাবে আসে, তা কেউ জানে না। যতদূর জানি পশু আমদানির জন্য কানো ঋণপত্র খোলা হয় না। তবু তা আসে। ইউটিউবে, সামাজিক মাধ্যমে তা সুন্দরভাবে দেখানো হয়। সীমান্তরক্ষী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সামনেই এসব আসে। কীভাবে তার ‘পেমেন্ট’ , কেউ জানে না। বিশ্বাস করা হয় এসব টাকা পরিশোধ হয় হুন্ডিতে। সোনা পাচারের মাধ্যমে। রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। সবচেয়ে বড় কথা এতে দেশীয় খামারিরা লোকসানে পড়ে। তাদের সারা বছরের শ্রম বিফলে যায়। দেশীয় খাবার, পশু উৎপাদন কাজ ব্যাহত হয়। এর ফাঁকে যে বিষয়টা বোঝা যায় না তা হচ্ছে, চাহিদা ও সরবরাহের বিষয়ে। সরকার বলছে, আমরা পশুতে উদ্বৃত্ত। তাহলে চোরাইপথে পশু আসছে কোন যুক্তিতে? এতে তো চোরাচালানি ব্যবসা লোকসানি হওয়ার কথা। অবশ্য মূল্যের প্রশ্নে এলে একটা উত্তর পাওয়া যায়। চোরাচালানকৃত পশুর দাম নাকি কম। এটা একটা উত্তর হতে পারে। ঘটনা যাই হোক, দেখা যাচ্ছে সোয়া কোটির মতো পশু এবার কুরবানি হয়েছে। এটা মিডিয়ার খবর। যদি তা সত্য হয়, তাহলে কুরবানির সংখ্যা গেল বছরের চেয়ে বেশি। এটা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খবর নয়।

সবাই বলছে, মূল্যস্ফীতিতে মানুষ ভীষণভাবে কষ্টে আছে। অনেকেরই ধারণা ছিল, এবার কুরবানির সংখ্যা কম হবে। যদি তা বেশি হয়ে থাকে, তাহলে কষ্টে থাকার বিষয়টি হয় প্রশ্নবিদ্ধ। তবে একটা কথা আছে। কুরবানি একটা পবিত্র দায়িত্ব, ধর্মীয় দায়িত্ব। মানুষ কষ্ট করলেও এ দায়িত্ব পালনে বিচ্যুত হতে চায় না। এ বিচারে কুরবানির সংখ্যাকে মেনে নেওয়া যায়। এদিকে দেখা যাচ্ছে চামড়ার বাজারে বেশ মন্দা ভাব। প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি ব্যাংকগুলো চামড়া ক্রয়ের জন্য ৫০০-৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বলে খবরে দেখলাম। এতদসত্ত্বেও চামড়ার ক্রেতা নেই। দাম ভীষণভাবে পড়ে গেছে। লবণের দামও অস্থিতিশীল, যা লাগে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে। চামড়ার বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বিদেশে চামড়াজাত দ্রব্যের বাজার ভালো। এ ক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানিও মোটামুটি ভালো। কিন্তু যে সংখ্যক চামড়া প্রতিবছর পাওয়া যায়, সেই তুলনায় এ শিল্পটি অগ্রসরমান নয়। বাজারে চামড়াজাত দ্রব্য, জুতা ইত্যাদির দামও প্রচুর। অথচ চামড়ার দাম নেই। এ বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। চামড়া শিল্পে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। ঢাকা শহরের মাঝখানে ছিল চামড়া কারখানাগুলো। ঝিগাতলা সংলগ্ন এলাকায়। একে সাভারে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। শিল্প মালিকরা অনেকদিন তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। বিষয়টি দৃশ্যত এখনো ‘হাঁসফাঁস’ অবস্থায় আছে, নাকি সম্পন্ন হয়েছে তা বিশদভাবে জানা যায় না।

চামড়ার বাজার, পশুর বাজার বাদ দিলে বাকি থাকে অন্যান্য পণ্যের মূল্য। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল মূল্যস্ফীতির ওপর কিছুটা হলেও ‘আঁচড়’ পড়বে। না, তা হয়নি। পেঁয়াজ, রসুন, মসলাপাতি এবং কুরবানির আনুষঙ্গিক সব জিনিসপত্রের দামই ছিল ঊর্ধ্বগতি। এসব মিডিয়ার খবর। ব্যবসায়ীরা যথারীতি এ ঈদেও কোনো রেয়াত ধর্মপ্রাণ মানুষদের দেয়নি। অথচ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছে, তা অনেক সংযত বাজেট। এতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মূলস্ফীতি রোধে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। প্রথমেই দেখা যাচ্ছে সরকার এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় বাজেটের আকার কম বৃদ্ধি করেছে। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে ছোট বাজেট। সরকারের যুক্তি হচ্ছে টাকার সরবরাহ বাজারে কম হোক। সরকারের টাকার সরবরাহ/খরচ কম হলে এর প্রভাব দ্রব্যমূল্যে পড়ার কথা। বাজেট শুধু ছোট হয়নি, পাশাপাশি চলছে কঠোর মুদ্রানীতি। ঋণের ক্ষেত্রে লাগাম টানা হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার কম ধরা হয়েছে। ঋণের খরচও বেড়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদনীতিতে বড় পরিবর্তন হয়েছে। ‘নয়-ছয় সুদনীতি’ পরিত্যাগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মোটামুটিভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সুদের ভবিষ্যৎ। ফলে ঋণের ওপর সুদের হার অনেক বেড়েছে। পূর্বতন ৯ শতাংশের জায়গায় ১২-১৩ শতাংশ হয়েছে, যদিও এর সুবিধা/উপকার আমানতকারীরা পায়নি। তাদের সুদের হার বেড়েছে সামান্য।

‘ব্যাংক হার’ অর্থাৎ যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিপদে-আপদে ঋণ দেয়, তার হারও বেশ উঁচুতে। সরকার নিজেও উচ্চ সুদে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে। এর অর্থ ‘সস্তায় ঋণ’-এই নীতি এখন কার্যকর নয়। এর ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হবে। ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হলে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম হবে। একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। এতে মুদ্রা সরবরাহে বেশ কিছুটা ব্রেক করা হবে, যা মূল্যস্ফীতি রোধ করার জন্য দরকার। সস্তা ঋণ ক্ষতিকর একটি বিষয়। শুধু এই কঠোর মুদ্রানীতি এবং ছোট বাজেট নয়, দেখা যাচ্ছে সরকার রাজস্ব নীতিতেও পরিবর্তন এনেছে। অর্থাৎ বহুদিন পর দেখা যাচ্ছে সরকার তিনটি নীতির সমন্বয় করার নীতি গ্রহণ করেছে। এ তিনটি নীতি হচ্ছে : মুদ্রানীতি (মনিটারি পলিসি), রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল পলিসি) এবং বাণিজ্যবিষয়ক নীতি। এ সমন্বয়ের জন্য বস্তুত বাংলাদেশ ব্যাংকে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটা ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ আছে। পূর্বতন অর্থমন্ত্রীর আমলে এ কাউন্সিল কার্যত অচলই ছিল। এটা এবার চালু হয়েছে বলে মনে হয়। বাণিজ্যনীতিতে দেখা যাচ্ছে সরকার আমদানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশ উদারভাব গ্রহণ করেছে। এসব পণ্য আমদানির বিষয়টিতে শৈথিল্য প্রদর্শিত হচ্ছে। এদিকে রাজস্বনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশটিরও অধিক ভোগ্যপণ্য আমদানিতে কর হ্রাস করা হয়েছে। পণ্যগুলো হচ্ছে ময়দা, লবণ, ধান, চাল, গম, আলু, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, মটর, ছোলা, আদা, হলুদ, শুকনামরিচ, ডাল, ভুট্টা, আটা ইত্যাদি। এছাড়া অবস্থাভেদে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দিচ্ছে, কর হ্রাস করছে। এসব ছাড়া রয়েছে সরকারের খোলাবাজার নীতি। ৫০ লাখ পরিবার বছরের ৫ মাস সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা পায়। প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি চাল। ‘টিসিবি’ ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২ কেজি সয়াবিন, ২ কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি চিনি বিতরণ করে। খাদ্য অধিদপ্তর ৩০ টাকা দরে বাজারে ৫ কেজি করে চাল বিক্রি করে। এসব করার জন্য টিসিবির গুদামের সংখ্যা এবং মাল সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার টাকা, যার উপকারভোগী লাখ লাখ মানুষ। এর জন্য ২০২৪-২৫ বছরের বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে।

দুঃখের বিষয়, এসব পদক্ষেপের পরও মূল্যস্ফীতির হার কোনোমতেই কমছে না। অবশ্য এতে একটা সমস্যা আছে এবং এটা বেশ বড় সমস্যা। প্রথমত ডলারের মূল্য, দ্বিতীয়ত বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। যত শুল্ক হ্রাসই করা হোক না কেন, তার একটা সীমা আছে। সরকারের রাজস্বও দরকার। দেখা যাচ্ছে যতটুকু পরিমাণ ভ্যাট, কর, শুল্ক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে হ্রাস করা হচ্ছে, তার পুরোটাই খেয়ে ফেলে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এখন সরকার যদি বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, নিয়মিতভাবে গ্যাস-জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়, ভর্তুকি হ্রাস করে, তাহলে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের আশা দূরাশায় পরিণত হয় না কি? কারণ তেলের দাম বৃদ্ধি মানেই পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, বিদ্যুতের খরচ বৃদ্ধি মানেই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। আর একটার দাম বাড়লে অন্যান্য জিনিসের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ে। আমরা মনে হয় এ প্যাঁচে পড়েই গেছি। এর থেকে মুক্তির পথ কঠিন। প্রধান কারণ আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতি। কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র-সবকিছুই আমাদের আমদানি করে খেতে হয়। অবস্থা এমন যে, আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ থেকে কাঁচামরিচও আমদানি করতে হয়। এমন আমদানিনির্ভর একটা দেশে বসবাস করে ডলারের উচ্চমূল্য/বর্ধিতমূল্যের প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি রোধের কথা বলা আর অসম্ভব স্বপ্ন দেখা, একই কথা।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম