এভাবে তো সৎরাও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনীতি ও বাজেট আমি তেমন বুঝি না। বাজেট পেশ হয়ে গেলে বুঝতে পারি, যখন টিভিতে, খবরের কাগজে দেখি সরকারপক্ষ বলতে থাকে, এটি গণমুখী বাজেট আর বিরোধীপক্ষ বলতে থাকে মানুষ মারার বাজেট, লুটপাটের বাজেট। এই সঙ্গে এখন সক্রিয় থাকে দু-একটি এনজিও সংস্থা, যারা অর্থনীতির নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে সাধারণত বাজেটের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে। বাজেটে ছিটেফোঁটা হলেও কোনো ভালো দিক যে আছে, তা তাদের প্রতিক্রিয়া শুনে বোঝার উপায় নেই। তবে এসব নিয়ে আমি বেশি মাথা ঘামাই না। অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আমার তেমন আগ্রহও নেই। সাধারণভাবে বেঁচেবর্তে থাকতে পারলেই চলে। ব্যাংকে কত টাকা জমা আছে বা জমা হলো, এসব খুব জটিল ও অপ্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়। ‘সরল জীবনেই শান্তি’-এই চিরকালীন দর্শনে আমি বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে এর পক্ষে উদাহরণও পাই। যেমন শুনে থাকি, এদেশের ‘বড় মানুষেরা’ অনেকে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি বিবেচনা করে তা আর ফেরত দেন না। এজন্য কখনো তাদের মর্মযাতনা হয় কিনা আমরা জানি না। আবার এ কথাও শুনি, নানা প্রভাব খাটিয়ে ধনীরা আরও ধনী হওয়ার লোভে জনগণের টাকা নিজের মনে করে পাচার করে দেন বিদেশে। তখন বুঝতে পারি বাইরের চেহারা যাই হোক, অন্তরে তাদেরও চৌর্যবৃত্তির জন্য মর্মযাতনা থাকে। অবৈধ টাকার গদিতে বসে এসব ভদ্র মুখোশের চোররা কি মনের দিক থেকে ভালো থাকে? ধরে নিচ্ছি, সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের ভাষ্যে কিছুদিন আগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সদ্য সাবেক পুলিশপ্রধান বিশাল সমুদ্র চুরির নজির স্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রশক্তির কাছাকাছি থেকে বাংলাদেশেই শত শত একর ভূ-সম্পত্তির মালিক হলেন। নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট-এসবের মালিক ও অংশীদার হয়ে গেলেন। এতই আলাদিনের চেরাগ হাতে ছিল যে, একদিনেই গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় চারটি ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন।
একটি মানুষের কতটা চাই! মনোবিজ্ঞানীরা হলে হয়তো বলতেন, এসব এক ধরনের মানসিক রোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হলো! উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার সব সম্পত্তি শুধু ক্রোকই হলো না, আদালতের নির্দেশে সেসব সম্পত্তির জন্য তত্ত্বাবধায়কও নিয়োগ দেওয়া হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে সব চলে এলো। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে পালানোর আগেই সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে হয়তো নানা এজেন্সির গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ব্যাংক খালি করে দিয়ে একগাদা টাকা অবৈধপথে পাঠিয়ে দিলেন নিরাপদে। শেষ পর্যন্ত এসব অর্থের কতটা ভোগ করতে পারবেন কিছুই বলা যাচ্ছে না।
তাহলে বেলাশেষে বেনজীর আহমেদের হাতে কী রইল? যদি বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের কাছে একজন বড় দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত থাকবেন। এতে হয়তো বেনজীরদের মতো মানুষের খুব বড় প্রতিক্রিয়া হবে না। ওই যে কথায় আছে, এক কান কাটা গেলে লজ্জায় মুখ লুকায় আর দুকান কাটা গেলে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। বেনজীরও হয়তো বুক ফুলিয়ে হাঁটবেন। কিন্তু স্ত্রী, কন্যা ও পরিবার-পরিজনদের কী হবে! তারা বৃহত্তর পরিবার, সমাজ সংসারের কাছে মুখ দেখাবেন কেমন করে! লজ্জা ও বিপদ এড়াতে না হয় পালিয়ে দেশান্তরী হলেন। তাতে কী লাভ হলো! বেনজীর ও তার পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি তো তাকে আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি দিয়েছে। যেখানেই যাবেন সেখানে অন্তত বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে দেখা হবে। তারা স্বাভাবিকভাবে তাকালেও স্ত্রী-কন্যাদের মনে হবে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সবাই। এর চেয়ে মর্মবেদনা আর কী হতে পারে! স্বাভাবিক মানবিক চেতনার মানুষ হলে তো মনে হবে ধরণী দ্বিধা হও!
মানুষ অন্যায় করার সময় সম্ভবত এতসব হিসাব করে না। আবার এটিও ঠিক, দুর্নীতির সম্পদ সবাই সমানভাবে হজম করতে পারে না। আর অন্যায়কারীর আশ্রয়দাতা এবং সহযোগীরাও কি খুব স্বস্তিতে থাকতে পারছে! সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় সরকারি এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহযোগিতা, ভরসা এবং ভাগবাঁটোয়ারা ছাড়া বেনজীর সাম্রাজ্য গড়তে পারতেন না। দায়িত্বপূর্ণ পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে বছরের পর বছর এত বড় দুর্নীতির ফিরিস্তি সংশ্লিষ্ট যাদের জানার কথা, তারা জানতেন না বললে মানুষ মানবে কেন! সাধারণ মানুষ তো এখন বলাবলি করছে বেনজীর দেশের ভেতর থাকলে ঝুলি থেকে অনেকের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে যাবে বলে তাকে আড়াল করা হয়েছে। অনেকের স্বার্থ এভাবে ঠিক রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেনজীরকে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যেসব সুবিধা পেয়েছে দলটি, এখন হিসাব করলে হয়তো দেখতে পাবে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারচেয়েও বেশি। নানা দিক থেকেই মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা হারাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী দলটি। এমন অবস্থায়ই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর অভাব অন্য কোনোভাবে পূরণ করা কঠিন।
বাজেটের পর নানা তথ্য মাধ্যমে ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে কথা উঠছে। সাধারণ করদাতাদের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। এর আগে যা দিতে হতো পঁচিশ শতাংশ। আর কালো টাকার মালিকদের বিশেষ সম্মান দেখানো হলো। তারা টাকাকে সাদা করার সুযোগ পাবেন মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়েই। আইন কী করবে আমি জানি না, কিন্তু টিভি জরিপে সাধারণ মানুষ মনে করছেন দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে সরকার। দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ অবাক হবে না, যদি একদিন বেনজীররা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সব বৈধ করে নেন। এ দেশে যদি সব কিছু সম্ভব হয়, তাহলে এসব দুর্বল ধারণাগুলো বাস্তবায়িত হলে অবাক হওয়ার কী থাকবে!
করের কথাই যদি এলো, তাহলে দুটো কথা বলতে হয়। আমরা যারা সৎভাবে কর দিতে চাই, তাদের দুর্ভোগের কথাও বলতে হবে। আমার সাধারণ যুক্তি, কর ব্যবস্থা এমন থাকা উচিত, যাতে করদাতা তার প্রকৃত আয় থেকে সহজেই আয়কর পরিশোধ করতে পারেন। এমনটি হলে আয়কর ফাঁকি দিতে হয় না। আর আয়ের আওতায় সানন্দে মানুষ যুক্ত হতে পারে।
একজন আয়করের হিসাব-নিকাশ না জানা মানুষ আমি, কীভাবে আমাদের মতো মানুষ সংকট প্রত্যক্ষ করি, তা বলতে চাই। এ যেন আমার মতো সবার কথা। আমি সততার সঙ্গে আমার ফাইলে ছোট-বড় সব আয় প্রদর্শন করেছি। আমার প্রধান আয় বেতন। পনেরো বছরের বেশি আমি ১ নম্বর গ্রেডে বেতন পাই। এছাড়া লেখালেখি করে সামান্য আয় হয়। পৈতৃক সূত্রে ঢাকায় কম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তা থেকে যৎসামান্য ভাড়া আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। এর বাইরে উল্লেখ করার মতো কোনো আয় নেই। আমার সম্পত্তির একটি অর্থমূল্য আছে ঠিকই। কিন্তু এ থেকে খুব কমই আয় আসে। ধরে নিই ইনকাম ট্যাক্স অফিস সব হিসাব করে আমাকে বার্ষিক নয় লাখ টাকার আয়ের মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। আমাকে এর ওপর ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। হিসাব করা হয় না ১০ বছর আগে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকায় সংসার চললেও এখন কমপক্ষে আশি হাজার টাকা লাগে। এর ওপর ২৫ শতাংশ আয়কর দেওয়া কষ্টকরই বটে। তবুও বৃহত্তর স্বার্থে এ কর পরিশোধের প্রস্তুতি আমি রাখি। কিন্তু সংকটটি অন্য খানে। আমার বেতন থেকে সরকারের প্রাপ্য আয়কর প্রতি মাসে কেটে নেওয়া হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় এ অর্থ পরিশোধ করে আমাকে রসিদ দিয়ে দেয়। যেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি, সেখান থেকেও একই নিয়মে পরিশোধ করে আমাকে রসিদ দেয়। একইভাবে প্রকাশকও আয়কর পরিশোধ করে রসিদ প্রদান করেন। এসব দলিল আমি কর অফিসে জমা দেই। এর বাইরেও আমাকে বছরে দুই লক্ষাধিক টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হয়। আর তা পরিশোধ করতে আমি প্রতিবছরই ঋণ করি। কেন এই অতিরিক্ত কর। নিয়মটি আমাকে বোঝানো হয় সব পরিশোধের পরও আয় থাক বা না থাক, আমার মোট সম্পদ অর্থমূল্যে বেশি, তাই এর ওপর আবারও আয়কর দিতে হবে। ফলে দুই প্রস্থে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয়কর দিতে হচ্ছে।
আমার দুরবস্থা দেখে এ বাজেটের পর আমার মতোই অর্থনীতির মারপ্যাঁচ না বোঝা বন্ধু পরামর্শ দিলেন, আপনি দু-তিন বছর আয়কর পরিশোধ না করে টাকাগুলোকে কালো করে ফেলেন। তারপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে আবার সাদা করে ফেলুন টাকা। এতে ১০ শতাংশ আপনার সাশ্রয় হতে পারে। বুঝলাম এটি বন্ধুর তির্যক রসিকতা।
যাই হোক না কেন, আমি আমার মতো ছা-পোষাদের নিয়ে ভাবছি। ঋণখেলাপি ও নানা দুর্নীতিবাজদের কারণে আমাদের দেশে অর্থের মেরুদণ্ডে আঘাত লাগছে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। দেশের আর্থিক রিজার্ভ কমছে। দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে প্রবাসীরা সরল পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে দ্বিধা করছে। আর এসব আর্থিক সংকট কাটাতে সরকার আয়কর বাড়াচ্ছে। সরকারি ভাষ্যে কালোটাকার মালিকদের টাকা ফিরিয়ে আনতে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিচার করলে দেখা যাবে দুর্নীতিবাজদেরই সর্বত্র জয়জয়কার। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব থাকছে সরকারের হাতে। দুর্নীতিবাজদের কারণে সরকারের আর্থিক খাত সচল রাখার জন্য আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের পেষণ করা হচ্ছে। আমাদেরও তো একটি সাধ্যের সীমা থাকে। তাহলে কি পরোক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের খাই মেটাতে আমাদেরও দুর্নীতির পথ খুঁজতে হবে? যেভাবে সব এগোচ্ছে, তাতে আশঙ্কা হচ্ছে অচিরেই বিশ্বের সব দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ সেরা হওয়ার কালো মুকুট হয়তো মাথায় পরবে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com.