‘মানুষ’ কথাটা খুব গণ্ডগোলের, ইংরেজিতে যাকে বলে প্রব্লেমেটিক। আমরা কথায় কথায় বলি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু চারপাশে মানুষের যে চেহারা দেখি, তাতে তাদের ওপর খুব একটা ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগে না। কেউ বলি, ‘মানুষই ইতিহাস তৈরি করে’; কেউ বলি, ‘মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে বলেই আমরা এত ভোট পেয়ে জিতেছি’; কেউ ক্যামেরার নজরে উত্তরের গুহায় আর দক্ষিণের পাথরে ধ্যানট্যান সেরে নিয়ে বলেন, ‘জনগণ হচ্ছেন জনার্দন (মানে আমাদের শুঁড়ধারী গণেশবাবু), তার আদেশ আমি মাথা পেতে নিলাম’, কেউ মন খারাপ নিয়ে ‘মানুষ’ কেন যে মুখ ফিরিয়ে নিল, সেই ধাঁধা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। মানুষ কারও পূজা পায়, কারও গোপন গালাগাল, কারও ক্রোধ, কারও অবজ্ঞা, কারও অভিমান। প্রিয় রঙের আবিরে নতুন খেলা হয়, আবার কোথাও নিষ্প্রদীপ অন্ধকার। মানুষের কাছে সেগুলো কীভাবে পৌঁছায় জানি না। আমিও এ মানুষকে চিনি বলে মনে হয় না, তাই এ মানুষের সংসারে গিয়ে দেখার সুযোগ নেই। তাই সে খাবার সময়ে এসব কারণে দুটো ভাত কম বা বেশি খাচ্ছে কিনা জানি না। যদি অবশ্য তার ভাত বা রুটি জোটে।
আমার মনেও তাই এ মানুষ কথাটা নিয়ে নানা ধন্দ আছে। ধন্দ মানে বেশ এক গোলানো অবস্থা। আচ্ছা, কোথাকার মানুষ? পৃথিবীর বাইরেকার, এ পৃথিবীর, আমার দেশের, রাজ্যের, না আমার শহরের, পাড়ার, রাস্তাঘাটের, না আমার বাড়ির? নাকি আমার আয়নার ছবিটার? কোন্খান থেকে তার শুরু, কোথায় তার শেষ? ‘পৃথিবীর বাইরেকার’ কথাটা শুনে পাঠক আমার ওপর রাগ করবেন না বা আমাকে আনকোরা গাধা ভেবে মুখ ঘুরিয়ে বসবেন না। সবাই তো জানে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও মানুষ নেই-এটাই এখনো পর্যন্ত একমাত্র গ্রহ, যে জীবনকে আশ্রয় দিয়েছে, লালন করছে-তাই কথাটা অদ্ভুত মনে হতেই পারে। কিন্তু বাউল যখন বলেন ‘মনের মানুষে’র কথা; বলেন, ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে’ তখন আমি খুব ঘাবড়ে যাই; ভাবি, এই মানুষ কি সত্যিই মানুষ, না গুরু লালনসাঁই আমাকে ভজিয়েভাজিয়ে এক ঈশ্বরকে গছিয়ে দিতে চাইছেন মানুষ নাম দিয়ে? নাকি মানুষকেই অতিকায়িত করে ঈশ্বরকে কুলোর বাতাস দিয়ে ভাগাচ্ছেন। এই নিয়ে আমি খুব বিভ্রান্ত থাকি। যাই হোক, পৃথিবীর বাইরেকার ‘মানুষ’ দিয়ে আমার কাজ নেই, আমি পৃথিবীর চেনা বা অচেনা মনুষ্যত্বেই ফিরে আসি।
ফিরে আসতে গিয়ে এখানে আরেকটা ক্যাচাল হয়। এ ক্যাচালের জন্মদাতা আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দেশের মানুষ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ তো নানাভাবেই লিখেছেন। ওদিকে যেমন ওয়াল্ট হুইটম্যান তার I hear America singing কবিতায় আমেরিকার মানুষদের নিয়ে খুব আম্বা প্রকাশ করেছেন, তা কবিরা ওরকম করতেই পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্যাপার হলো এই যে, তিনি দেশের মানুষকে বেশ ভালোই চেনেন বলে মনে হয়, আমাদের চেনাতেও চান; আবার সেখান থেকে কী অক্লেশে পৃথিবীর মানুষেও পৌঁছে যান। দেশের মানুষকে কেমন করে চিনতেন বা চেনেন, তা যে আমরা সবাই জানি, তা নয়। তিনি এদেশকে নানা ধর্ম, ভাষা আর সংস্কৃতির এক মিলনতীর্থ বলে মনে করেন, ‘জনগণমন’ গানে আর অন্যান্য হাজার হাজার রচনায় তার প্রমাণ আছে। এ তো একটা আদর্শের দিক, আইডিয়ালের দিক। আবার রাজনীতির উচ্ছ্বসিত কল্পনার ‘ভারতমাতা’, ‘ভারতলক্ষ্মী’ এসব ফালতু গুলতাপ্পির ওপর ঢিল-পাটকেল ছুড়ে বলেন, ‘ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ সুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র-কিন্তু ভারতমাতা যে আমাদের পল্লিতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়া-জীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্যভান্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা।’ কল্পনা থেকে বাস্তব আর বিমূর্ত থেকে মূর্ত-সব কেমন গুলিয়ে যায় আমার। একদিকে ভদ্রলোক The Religion of Man-এর বক্তৃতাগুলোতে the essential Man, Man the eternal, Man the divine বলে বলে আমাদের কানের পোকা বার করে দেন, বলেন যে মানুষ দেশে অনন্ত, কালে অনন্ত : ব্যক্তি মানুষ মরে যায়, কিন্তু মানবতা মরে না। অন্যদিকে নিজের লেখায় কাজে ব্যক্তিদের সুখ-দুঃখের গল্প বলে আমাদের হাসান, কাঁদান, আরও কত কী করেন। সেখানে কাবুলিওয়ালা আছে, রাইচরণ আছে, চন্দরা আছে, ফটিক আছে, কবিতার ছেলেটা আছে, বাঁশিওলা, চণ্ডালিকা প্রকৃতি আছে, কে নেই? সব লিখতে গেলে সে এক মহাভারত হয়ে যাবে। ‘সমাপ্তি’ গল্পে মেয়েটির সেই বাবাটিও আছে যে জাহাজঘাটের টিকিট বিক্রির কাজ থেকে ছুটি না পেয়ে নিজের মেয়ের বিয়েতেও হাজির থাকতে পারল না। ভাবুক রবীন্দ্রনাথ আমাদের পৃথিবীর মানবতার অর্থ বোঝাতে চান, আবার সব লেখকের মতোই স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ আমাদের ব্যক্তি মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। দুইয়ের মধ্যে কী যোগ আছে, তা কি আমরা সবসময় বুঝতে পারি? বিমূর্ত আর মূর্ত-দুই প্রান্তকেই যে সম্মান করতে হবে, ভালোবাসতে হবে, তা কি আমরা জানি? রাজনীতির লোকরাও সবাই জানেন?
হয়তো জানেন, তাদের মতো করে, তাদের লক্ষ্য বুঝে। তাই তারা নির্বাচনে বেরিয়ে অস্পৃশ্যের ঘরে পাত পেড়ে বসে যান, উৎসুক জনতার মধ্য থেকে মায়ের কোলের শিশুটিকে কোলে তুলে নেন, বালকের সঙ্গে হস্তমর্দন করেন। কেউ ভান করেন, কেউ করেন না। জানেন, তাদের ব্যক্তিও চাই, সমষ্টিও চাই। ব্যক্তিকে খুশি করলে সমষ্টিও খুশি হবে, ভোটটা আমার বাক্সে আসবে-এ হিসাবে কোনো অন্যায় নেই; তাদের তো ক্ষমতায় থাকতে/আসতে হবে! আমাদের রাজনীতির যেসব পরিভাষা, ‘গণতন্ত্র’, ‘প্রজাতন্ত্র’ ইত্যাদি-সবকিছুর পেছনেই তো মানুষের ছায়া রয়েছে, তাই না? অর্থাৎ এসব ব্যবস্থায় মানুষই সর্বেসর্বা। মানুষের আরেকটা প্রতিশব্দ হলো ‘লোক’-তা-ও সংস্কৃত শব্দ, অর্থ যেমনই দাঁড়াক। আমাদের লোকসভা, লোকহিত কথাগুলোতে তার স্বীকৃতি থেকে গেছে। এ ‘লোক’ উৎপল দত্তের নাটকের কোনো ‘ভূতপূর্ব লোক’ নয়, জ্বলজ্যান্ত ভারতের আঠারো বছরের ঊর্ধ্বগত নাগরিক, যে আসলে ভোটার। নির্বাচনে তাকে নিয়েই যত টানাটানি। তার সাত জন্ম উদ্ধার করার জন্য সব লাফিয়ে পড়ে, তাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যায়-আওয়াজে, আদরে, আবদারে, আহ্বানে, আমন্ত্রণে। ভোট হয়ে গেলে শান্তি।
না, শান্তি আর কোথায়! ভোটের আগে অশান্তি হয় আজকাল, ভোটের মধ্যে আর পরেও। মানুষ বোধহয় এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সবই হচ্ছে ‘মানুষের’ ভালোর জন্য।
শুধু দেশের মানুষই কখনো কখনো বেগড়বাই করে। সবাই নিজের ভালো বোধহয় তেমন করে চায় না। নইলে মধ্যরাত্রিতে নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরে সাতাত্তর বছর হয়ে গেল, কেন দেশের লোক সবাই সভ্যভব্য হতে শিখল না! বিলেত-আমেরিকা-জাপান যাই, সবাই কেমন ফিটফাট থাকে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার, সুন্দর দৃশ্য চারদিকে। আর আমার দেশের কিছু লোক দ্যাখো, কী রকম নোংরা থাকে, নোংরা করে চারদিক, এখনো রেললাইনের ধারে সকালে বাথরুম করতে বসে যায়। আবার ফুটপাতে ঘর বাঁধে, তাদের ন্যাংটো বাচ্চারা পথে গড়াগড়ি খায়! এত কষ্ট করে একজন ‘অচ্ছে দিন’ না কী একটা এনে দিলেন, নতুন লোকসভার বাড়ি, নতুন রামমন্দির অযোধ্যায়, বন্দে ভারত, হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে, ধবধবে এলসিডি আলো আর টুনিবাল্বে সাজানো শহর-আরও কত কী। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ এমন হতচ্ছাড়া যে খামোখা ইচ্ছে করে একশজনে দশজন দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে গেল, বেকার রইল দশজনের বেশি। কত গণ্ডায় গণ্ডায় শিক্ষানীতি হলো, কিন্তু এখনো দেশের প্রায় চার ভাগের একভাগ লোক লেখাপড়া শিখবে না বলে গোঁ ধরে বসে রইল।
আমাদের দেশের লোক কবে যে ‘মানুষ’ হবে! যাই হোক, নির্বাচনটাই আসল। নইলে ও ছাতার মানুষকে কে পুঁছত?
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয, কলকাতা